ভাবসম্প্রসারণ লেখার নিয়ম


ভাবসম্প্রসারণ লেখার নিয়ম

ভাবসম্প্রসারণ লেখার নিয়ম: 

ব্যাপক ঐশ্বর্যমণ্ডিত কোনো ভাব অনেক সময় প্রচ্ছন্ন সংহতি লাভ করে নির্মেদ কবিতা বা গদ্যের প্রবাদ- প্রতিম মিত অবয়বে। সে অবয়বের ক্ষুদ্রতম সীমা একটি কবিতার চরণ কিংবা একটি গদ্যাংশ। এ ধরনের সীমিত পরিসরে বীজধর্মী সংহতি পায় ব্যাপক ভাবব্যঞ্জনা। সেই ভাববীজটির উন্মোচন ও সম্প্রসারিত প্রকাশের কাজটিকেই বলা হয় ভাবসম্প্রসারণ । তবে মনে রাখতে হবে, ভাবসম্প্রসারণ যেমন প্রবন্ধ নয়, তেমনি এটি ব্যাখ্যার পর্যায়েও পড়ে না ।


 ভাবসম্প্রসারণ কথাটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণঃ  


'ভাব' শব্দটি বহু অর্থবাচক, অর্থাৎ একাধিক অর্থ বহন করে এবং এর ব্যবহারও বহুমাত্রিক। এখানে ভাব' শব্দটির অর্থ মর্ম' বা নিগূঢ় অর্থ । আমরা জানি, সাহিত্যমাত্রই ভাবাশ্রয়ী। গদ্য কিংবা কাব্য যে কোনো রীতির সাহিত্যে সাহিত্যিকের অনুভূতির গাঢ়তা' (Emotion) লুকিয়ে থাকে। একে বলা হয় সাহিত্যের ভাব। তাহলে শাব্দিক অর্থে, ভাবসম্প্রসারণ বলতে ভাব-এর তথা অনুভূতির গাঢ়তা-এর প্রসারণকেই বোঝায়। যে কোনো রীতির সাহিত্যের দু একটি চরণে বা অংশে একটি ভাব বা নিগূঢ় অর্থ প্রচ্ছন্ন থাকে, যা মানবজীবনের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। যথাযথ যুক্তি, বিশ্লেষণ ও সহজবোধ্য ভাষায় সেই গভীর ভাব-এর প্রসারণকে ভাবসম্প্রসারণ বলা হয় । সহজ কথায় ভাবসম্প্রসারণ হলো প্রাঞ্জল ভাষায় কোনো উদ্ধৃত সাহিত্যাংশের মূলভাবের বিস্তৃতি ঘটানো ।

 

ভাবসম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তাঃ

 

ভাবসম্প্রসারণ লেখার নিয়ম

কবি-সাহিত্যিকদের লিখিত প্রতিটি চরণ ও বাক্যাংশ তাৎপর্যপূর্ণ। এতে মানুষের জীবন ও জগৎ সম্পর্কে গূঢ় কথাগুলো তাদের উপমা, অলঙ্কার, যুক্তি ইত্যাদির আবরণে ভাবের গভীরে লুক্কায়িত থাকে। এ গূঢ় কথাগুলো সর্বসাধারণের কাছে সহজবোধ্য করার নিরিখেই ভাবসম্প্রসারণের উদ্ভব। গূঢ়ার্থক সাহিত্যকে সহজবোধ্য করার ক্ষেত্রে ভাবসম্প্রসারণের গুরুত্ব অপরিসীম। নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে একটি সংক্ষিপ্ত অথচ অর্থপূর্ণ বক্তব্যকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার কৌশল ও ক্ষমতা রপ্ত করা যায় ৷

 

ভাবসম্প্রসারণের প্রক্রিয়াঃ

ভাবসম্প্রসারণ লেখার নিয়ম


ভাবসম্প্রসারণের কাজটি যথাযথ ও বিশদভাবে করার ক্ষেত্রে নিচের নির্দেশনাগুলো সহায়ক হতে পারে :

মূলভাব শনাক্তকরণ

ক. প্রদত্ত চরণ বা বাক্যটি সাধারণত সারগর্ভ বাক্য, ভাবগর্ভ চরণ কিংবা মননগর্ভ প্রবাদ হয়ে থাকে। একাধিকবার অভিনিবেশ সহকারে তা পড়ে নিতে হবে। যেন প্রচ্ছন্ন বা অন্তর্নিহিত ভাবটি কী তা বোঝা যায় ।

খ. মূলভাব উপমা, রূপক, প্রতীক বা সংকেতের আড়ালে আছে কিনা তা বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে। ভাব বিশ্লেষণে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে উপমা-রূপক-প্রতীক বা সংকেতের মর্ম উপলব্ধি করা বিশেষ প্রয়োজন। তাহলে ভাবের মূল অভিমুখিনতা স্পষ্ট হবে। এ রকম স্থলে ভাবসম্প্রসারণে একটি বা দুটি অতিরিক্ত অনুচ্ছেদ থাকতে পারে। তাতে (ক) উপমা, রূপক ইত্যাদির অর্থপ্রকাশ এবং (খ) তার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে হবে ।


প্রদত্ত ভাবসত্য বা বক্তব্যে উপনীত হওয়ার পেছনে যেসব যুক্তিসূত্র কাজ করেছে এবং যে ধরনের প্রেক্ষাপটে ভাবসত্যটি তাৎপর্যপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় সেগুলো অনুধাবনে সচেষ্ট হতে হবে । সহজ ভাষায় সংক্ষেপে সেগুলো প্রয়োজনমতো উপস্থাপন করতে হবে।

 

ভাবের সম্প্রসারণঃ


মূল ভাববীজকে বিশদ করার সময় সহায়ক দৃষ্টান্ত, তথ্য ও প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতির ব্যবহার করা চলে। এমনকি প্রয়োজনে ঐতিহাসিক, পৌরাণিক বা বৈজ্ঞানিক তথ্য উল্লেখ করা যায় । তবে অবশ্যই তা হতে হবে প্রাসঙ্গিক। অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক তথ্যের সমাবেশ ঘটলে সম্প্রসারিত ভাব ভারাক্রান্ত ও নীরস হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে । কোনো প্রবাদ-প্রবচন বা সুভাষিত উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করলে তা যথাযথ ও নির্ভুল হওয়া চাই । ভুল বা অপ্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি দেয়ার চেয়ে না দেয়াই ভালো ।

 

ভাষা কৌশলঃ


ভাবসম্প্রসারণের ভাষা যথাসম্ভব সহজ, সরল ও স্পষ্ট হওয়া চাই । দীর্ঘ, কঠিন ও সমাসবদ্ধ শব্দ ও জটিল বাক্য যথাসম্ভব পরিহার করে চলা উচিত। ভাষা উচ্ছ্বাসময় হবে না, বরং অলংকৃত ও সাহিত্য গুণান্বিত হবে। প্রারম্ভিক বাক্যে সাধারণত সাধারণ ভাবটি উপস্থিত হওয়া উচিত। তা শ্রুতিমধুর, ভাবঘন ও সৌকর্যমণ্ডিত (Decorative) হলে ভালো হয় ।

 

 গঠন কাঠামোঃ

ভাবসম্প্রসারণ লেখার নিয়ম

ক. একই কথার পুনরাবৃত্তি ও অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা ভাবসম্প্রসারণের ক্ষেত্রে দোষের। প্রদত্ত কবিতা বা গদ্যের শব্দ বা শব্দগুচ্ছ হুবহু ব্যবহার করাও সঙ্গত নয় ।


খ. ভাবসম্প্রসারণ যেহেতু মূলভাবের সম্প্রসারণ সেজন্য প্রদত্ত রচনাংশের কবি বা লেখকের নাম জানা  থাকলেও তা উল্লেখের প্রয়োজন নেই। কোনো শব্দের টীকা-টিপ্পনী দেয়ার প্রশ্নও এখানে ওঠে না। কী ব্যাখ্যার মতো কবি এখানে বলতে চেয়েছেন, লেখকের ধারণা ইত্যাদি বাক্যবন্ধও লেখা উচিত নয় ।

 

গ. ভাবসম্প্রসারণ কত বড় হবে তা পরীক্ষার বেলায় প্রধানত প্রদেয় নম্বরের ওপর নির্ভর করে । এটা যেন প্রবন্ধের মতো দীর্ঘ কলেবর না হয়, আবার আকারে ব্যাখ্যার মতো অনুদীর্ঘ না হয় । সাধারণত শব্দ সংখ্যা হবে দুইশ' থেকে আড়াইশ' । লাইন হবে বিশ থেকে পঁচিশটি । বিশেষ ক্ষেত্রে এ পরিসরের বাড়তি বা কমতি হতে পারে ।

 

ঘ. ভাবসম্প্রসারণের অনুচ্ছেদ সংখ্যা নির্ভর করে মূল ভাবের ওপর। সে হিসেবে এক বা একাধিক অনুচ্ছেদে ভাবসম্প্রসারণ করা চলে । তবে ভাবসম্প্রসারণ দুই-তিন অনুচ্ছেদের বেশি না হওয়াই ভালো ।


উদ্ধৃতি ব্যবহারঃ

ভাবসম্প্রসারণে বিখ্যাত মনীষীদের উক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে লক্ষ রাখতে হবে, তা যেন মূলভাব পরিস্ফুটনে সহায়ক হয়। অন্যথায়, অপ্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতির ব্যবহার লেখার মান কিংবা মূলভাবের প্রসারণকে দুর্বল করে তুলবে ।

 

বিশেষ সতর্কতাঃ


ক. বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি পরিহার করতে হবে ।

খ. ভাবসম্প্রসারণে কবি/লেখকের নাম বা উদ্ধৃতির উৎস নির্দেশের প্রয়োজন নেই।

গ.কবি বলেছেন' কিংবা 'এখানে বক্তব্য হলো-এ ধরনের প্রকাশভঙ্গি ভাবসম্প্রসারণে পরিত্যাজ্য ।

ঘ. ভাবসম্প্রসারণ মানে প্রদত্ত ভাবের প্রসারণ । কাজেই, ভাবসম্প্রসারণে সমালোচনামূলক কোনো মন্তব্য করা অনুচিত।

Post a Comment

Previous Post Next Post