শিল্পায়ন ও শহরায়ন কি? শিল্পায়ন ও শহরায়নের মধ্যে সম্পর্ক ও পার্থক্যগুলো বর্ণনা কর।

 শিল্পায়ন ও শহরায়নের মধ্যে সম্পর্ক ও পার্থক্যগুলো বর্ণনা কর।

শহরায়ন ও শিল্পায়ন কি?  শিল্পায়ন ও শহরায়নের মধ্যে সম্পর্ক ও পার্থক্যগুলো বর্ণনা কর।


ভূমিকা :


শিল্পায়ন ও শহরায়ন হলো শিল্পবিপ্লবের ফলশ্রুতি। শিল্পায়ন শহরায়নকে ত্বরান্বিত করে, আবার শহরায়নও শিল্পায়নের সুযোগ তৈরি করে। শিল্পায়ন ও শহরায়নের মাঝে। এ ধরনের সম্পর্ক থাকলেও উভয়টি কিন্তু সম-অর্থবোধক ধারণা নয়। শিল্পায়ন হলো যান্ত্রিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে বৃহদায়ন উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া এবং এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক বিভিন্ন দিকের পরিবর্তন সাধিত হয় । অন্যদিকে, শহরায়ন হলো শহরবাসী হওয়ার জন্য শহরের দিকে লোকজনের ধাবমান হওয়া, কৃষিকার্য ছাড়া অন্য পেশাকে বৃত্তি হিসেবে নেওয়া এবং সামাজিক রীতিনীতি পরিবর্তনের পদ্ধতি ।


শিল্পায়ন কি : 


সাধারণত শিল্পায়ন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যাকে উৎপাদন পদ্ধতিতে প্রয়োগ করে সনাতন উৎপাদন প্রক্রিয়াকে যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতিতে পরিবর্তন করা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, বিজ্ঞানভিত্তিক যান্ত্রিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বৃহৎ আকারের উৎপাদন পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রক্রিয়াকে শিল্পায়ন বলা হয় ।


প্রামাণ্য সংজ্ঞা :


জেরি এবং জেরি (Jary and Jary) এর মতে, "Industrialization is the general process by which economics and societies in which agriculture and the production of handicrafts predominate become transformed into economics and societies where the manufacture and related extractive industries are central."


জাতিসংঘ শিল্পায়ন কমিটির মতে, শিল্পায়ন অর্থনৈতিক উন্নয়নের এমন এক প্রণালি যাতে জাতীয় সম্পদের একটি ক্রমবর্ধমান অংশ অভ্যন্তরীণ আর্থিক সংগঠনের জন্য নিযুক্ত হয়। যা প্রযুক্তিবিদ্যা সম্মত, আধুনিক ও বৈচিত্র্যময়।


অধ্যাপক জিসবাটের (Prof. Gisbert) মতে, শিল্পায়ন হলো এমন এক অবস্থা যার ফলে লোকসংখ্যার অভূতপূর্ব বৃদ্ধি, অসম বণ্টন, জীবনযাত্রার মানের উন্নতি, দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা, অপসারণ এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটে।


সোভিয়েত লেখক Tyaguneko ও Koliontai বলেন, শিল্পায়ন বলতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কেবলমাত্র একটি বিশেষ দিক বুঝায় না, এটি উন্নত দেশগুলোর যাবতীয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক উপায়ে এবং বৃহদায়ন উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি প্রক্রিয়া, যার দ্বারা বৃহদায়ন উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তির উন্নততর পদ্ধতির প্রয়োগ করা যায়। সমগ্র অর্থনীতির নবীকরণ হয় এবং শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকে ।


ড. আলী আকবর বলেন, উৎপাদন, যাতায়াত, পরিবহণ, যোগাযোগ, বাজার ও সম্ভাব্য সব ক্ষেত্রে যান্ত্রিক প্রযুক্তি ব্যবহার শিল্পায়নের অন্তর্ভুক্ত।

 

শহরায়ন বা নগরায়ন বলতে কি বুঝায় : 


শহরায়ন হলো শহর বা শহরাঞ্চলে জনগণের কেন্দ্রীভূত হওয়ার প্রক্রিয়া। শহরায়ন হচ্ছে প্রধান সমষ্টি হতে বৃহত্তম সমষ্টিতে অর্থাৎ গ্রাম ছেড়ে শহরে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া।

 

প্রামাণ্য সংজ্ঞা :


মিচেলের (Mitchel) মতে, শহরায়ন হলো শহুরে হওয়ার প্রক্রিয়া, কৃষি ছেড়ে অন্য পেশা গ্রহণ, যা শহরের সবাই গ্রহণ করে এবং সাথে সাথে আচরণগত ও রীতিনীতির পরিবর্তন হয়।


Encyclopedia of Social Science অনুযায়ী, কৃষিপ্রধান এলাকার জনসমষ্টি যাদের কৃষিই একমাত্র পেশা, তা ছেড়ে বৃহৎ জনসমষ্টি অধ্যুষিত এলাকা যেখানে সরকারি অফিস, ব্যবসা বাণিজ্য ও কলকারখানা অবস্থিত সেখানে স্থানান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়াই শহরায়ন।"


জাতিসংঘের সংজ্ঞানুযায়ী, "Urbanization is the process whereby an increasing of countries population lives in an urban locality."


ECAFE (Economic Commission for Asia and The Far East) এর ভাষ্যানুযায়ী, শহরায়ন বলতে এমন এক প্রক্রিয়াকে বুঝায় যেখানে জনগণ স্বাভাবিকের চেয়ে বড় আকারে একত্রিত হয়ে বসবাস করতে সচেষ্ট হয়।


সমাজকল্যাণ অভিধান অনুযায়ী, "Urbanization is the process by which urban social structures and functions development in a population or an area. 


সমাজবিজ্ঞানী এন. এন্ডারসন (N. Anderson) বলেন, কোনো ব্যক্তি বা দলের পেশাগত পরিবর্তন নয়; বরং মানুষের চিন্তা, ব্যবহার ও মূল্যবোধের মৌলিক পরিবর্তন সাধনই শহরায়ন ।"


এফ. আর. খান (F. R. Khan) বলেন, শহরায়ন হলো একটি জীবনধারা যা শহর এলাকা থেকে ক্রমশ বিস্তার লাভ করে।


শিল্পায়ন ও শহরায়নের মধ্যে সম্পর্ক :

 

শিল্পায়ন ও শহরায়ন খুবই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। নিম্নে উভয়ের সম্পর্ক আলোচনা করা হলো-


১. ধারণাগত : 

শিল্পায়ন শহরায়নকে ত্বরান্বিত করে আবার শহরায়ন শিল্পায়নের সুযোগ তৈরি করে। একদিকে শহরমুখী মানুষের শিল্পায়নের প্রতি নির্ভরশীলতা তৈরি হয়। অন্যদিকে, শিল্পায়নের ফলে মানুষ শহুরে জীবনে আগ্রহী হয় ।

২. বৈশিষ্ট্যগত : 

শিল্পায়ন ও শহরায়নের বৈশিষ্ট্য প্রায় অভিন্ন । যেমন পেশা, আধুনিকায়ন, উন্নত জীবনমান, একক পরিবার, সরকারি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।


৩. আধুনিক সমাজব্যবস্থা : 

শহর গড়ে ওঠে শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। প্রত্যেকটি উন্নত সমাজের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায় বেশিরভাগই শহরকেন্দ্রিক। আধুনিক সমাজের উন্নয়ন শিল্পায়ন ও শহরায়নের ফলেই সম্ভব।


৪. গতিশীলতা : 

সাধারণত শিল্পায়ন ও শহরায়ন একই সাথে ঘটে থাকে এবং একটি অপরটিকে ছাড়িয়ে যায় । অর্থাৎ শিল্পায়ন ও শহরায়ন উভয়ই গতিশীল ।


৫. স্থানীয়করণ : 

শিল্পায়ন ও শহরায়ন উভয় প্রক্রিয়ার সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো স্থানীয়করণ। শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বহুশিল্প প্রতিষ্ঠান পাশাপাশি একই এলাকায় গড়ে ওঠে আবার শহরায়নের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ধীরে ধীরে জনবসতি গড়ে ওঠে এবং এলাকায় শহরায়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়।


৬. চাহিদা পূরণ :

শিল্পায়ন মানুষের উন্নত জীবনযাপনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। অন্যদিকে, শহরায়ন ও উন্নত পণ্যসামগ্রীর প্রয়োজন অনুভবের মাধ্যমে শিল্পায়নের সুযোগ সৃষ্টি করে। এভাবে উভয়ই মানুষের চাহিদা পূরণে সম্পৃক্ত ।


৭. পরিপূরক :

যখন কোনো এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে তখন ঐ এলাকায় বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শহরও গড়ে ওঠে। আবার অনেকক্ষেত্রে শহর বা নগরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানা গড়ে ওঠে। ফলে একে অপরের পরিপূরক।


৮. নির্ভরশীলতা :

শিল্পায়ন শহরায়ন পরস্পর নির্ভরশীল এবং একে অপরকে প্রভাবিত করে। আধুনিক যুগে শিল্পায়ন ও শহরায়ন পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত।


৯. অবকাঠামোগত উন্নয়ন : 

যে অঞ্চলে শিল্পায়ন ও শহরায়ন গড়ে ওঠে সে এলাকায় উন্নত যোগাযোগ, পরিবর্তন ব্যবস্থা, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, ডাকঘর, অফিস-আদালত, ব্যাংক-বিমা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয় ।


১০. আবিষ্কার :

শহরায়নের প্রভাবে মানুষের চাহিদার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে, আধুনিক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পায়। শিল্পায়ন ও নতুন নতুন পণ্যাদি উদ্ভাবন ও উৎপাদন করে। ফলে এদের প্রভাবে নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কৃত হয়।

 

 

শিল্পায়ন ও শহরায়নের মধ্যে পার্থক্য : 

শিল্পায়ন ও শহরায়নের মধ্যে যথেষ্ট সম্পর্ক থাকলেও উভয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্যও বিদ্যমান। নিম্নে উভয়ের পার্থক্য আলোচনা করা হলো-


১. সংজ্ঞাগত :

শিল্পায়ন বলতে প্রধানত সনাতন উপায়ে মনুষ্যনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার স্থলে যান্ত্রিক পদ্ধতির ব্যাপক উৎপাদন প্রক্রিয়াকে বুঝায়। অন্যদিকে, শহরায়ন এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বসবাসের জন্য ক্রমান্বয়ে শহরমুখী ধাবিত হওয়ার প্রবণতাকে বুঝায়। ফলে উভয়ের সংজ্ঞাগত পার্থক্য রয়েছে।


২. উদ্ভবগত : 

শিল্পায়নের সূচনা হয় মূলত অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে সংঘটিত শিল্পবিপ্লবের সময়ে বা পরবর্তী সময়ে । পক্ষান্তরে, অতি প্রাচীনকাল থেকেই শহর তথা নগরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়।


৩. পদ্ধতিগত : 

শিল্পায়ন হচ্ছে মূলত যান্ত্রিক প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন পদ্ধতি । অন্যদিকে, শহরায়ন হচ্ছে একটি জীবন পদ্ধতি। ফলে এক্ষেত্রে উভয়ের পার্থক্য বিদ্যমান।


৪. পরিবর্তনগত :

শিল্পায়ন হচ্ছে উৎপাদন পদ্ধতির স্থানিক পরিবর্তন। অন্যদিকে, শহরায়ন হচ্ছে জনসংখ্যার স্থানিক, পেশা এবং জীবনধারার পরিবর্তন ।


৫. ধারণার ভিন্নতা : 

শিল্পায়ন হচ্ছে কলকারখানায় বিপুল উৎপাদন ব্যবস্থা এবং এ ব্যবস্থায় যান্ত্রিক প্রযুক্তির ব্যবহার। অন্যদিকে, শহরায়ন হচ্ছে শহরে বসতি স্থাপন এবং কৃষি ও অন্যান্য গ্রামীণ পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশা ও জীবনযাত্রার পদ্ধতি গ্রহণ ।


৬. স্থাপনাগত:

শিল্পায়নের ক্ষেত্রে একই স্থানের পাশাপাশি বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। আবার শহরায়নের ক্ষেত্রে পুঞ্জিভূত জনবসতি স্থাপিত হয়।


৭. জীবনধারণগত : 

শিল্পায়ন মানুষের জন্য উন্নত জীবনধারণের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। অপরদিকে, শহরায়ন মানুষকে উন্নত জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে গড়ে তোলে ।


৮. সাংস্কৃতিক গতিশীলতা : 

শিল্পায়ন মানুষের চাহিদাকে বৃদ্ধি করে এবং বস্তুগত সংস্কৃতির দ্রুত পরিবর্তন সাধন করে। অন্যদিকে, শহরায়নের মাধ্যমে জীবন পদ্ধতি তথা অবস্তুগত সংস্কৃতিতে যে পরিবর্তন আসে তা অতি ধীরগতিসম্পন্ন ।


উপসংহার :


উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, শিল্পায়ন ও শহরায়ন প্রত্যয় দুটি সাধারণভাবে একই সাথে ব্যবহার করা হলেও প্রকৃতপক্ষে উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। তবে বাস্তবক্ষেত্রে শিল্পায়ন ও শহরায়ন ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। শিল্পায়ন এবং শহরায়ন ছাড়া কোনো আধুনিক সমাজের উন্নয়ন সম্ভবপর নয়। যা আমাদের জীবন যাত্রায় উন্নয়ন ঘটায় এবং আধুনিক যুগের সূচনা করে।

 


Post a Comment

Previous Post Next Post