রোমান সভ্যতা , রোমান সভ্যতার অবদান
রোমান সভ্যতা প্রাচীন বিশ্বের উন্নত সভ্যতাগুলোর অন্যতম। ঐতিহাসিক প্যান্টাজেনেট সমারসেট ফ্রাইয়ের (দা হিস্ট্রি অব দ্য ওয়ার্ড) মতে, 'ইতিহাসে রোমান সভ্যতার প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি, তারপরেও এর খুব ক্ষুদ্র অংশই ছিল মৌলিক।' গ্রিক সভ্যতা ম্লান হয়ে যাওয়ার আগেই রোমান সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। এ সভ্যতা গড়ে ওঠে মধ্য ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ইতালীয় ছোট শহর রোমকে কেন্দ্র করে যা বর্তমানে দেশটির রাজধানী। রোমান কিংবদন্তি অনুসারে নির্বাসিত দুই রাজপুত্র রোমিউলাস ও রোমাস সিংহাসন পুনরাধিকার করে খ্রিষ্টপূর্ব ৭৫৩ অব্দে রোম নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। রোমিউলাসের নামানুসারে রোম নগরীর নামকরণ হয়। এভাবে খ্রিষ্টপূর্ব ৮ম শতাব্দীর মধ্যভাগে যাত্রা শুরু করে এ সভ্যতা খ্রিষ্টীয় ৪৭৬ অব্দ পর্যন্ত বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
ভৌগোলিক অবস্থান:
ইতালির পশ্চিম সীমান্তের কাছে অবস্থিত শহর রোমকে কেন্দ্র করে রোমান সভ্যতা গড়ে ওঠে। এর পশ্চিমে আপেনাইন পর্বতমালা, উত্তরে আল্পস পর্বতমালা, দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর এবং উত্তর-পূর্বে আড্রিয়াটিক সাগর। উত্তর-পূর্বে আড্রিয়াটিক সাগরের অপর পাশে বলকান অঞ্চল তথা মধ্য ইউরোপীয় ভূখণ্ড। রোম নগরী সাতটি পাহাড়ের ওপর ছড়িয়ে আছে। তাই এটিকে ‘সাত পর্বতের নগরী' (The City of Seven Hills) বলা হয় ৷
রোমানদের সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক ইতিহাস:
৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে ইন্দো-ইউরোপীয় জাতিগোষ্ঠীভুক্ত ইট্সকানরা টাইবার নদীর উত্তর দিকে অবস্থিত তুসকানি অঞ্চল দখল করে। কিন্তু পার্শ্ববর্তী শক্তিশালী গ্রিকদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। অবশেষে রোমের নেতৃত্বে ইতালীয় জাতিগুলো ইট্সকানদের পরাজিত করে রোমান সভ্যতার সূচনা করে। রোমানরা রাজ্য শাসনে নতুন ব্যবস্থা চালু করে। দুইজন অভিজাতের হাতে রাষ্ট্রশাসনের ক্ষমতা দেওয়া হয়। এদের বলা হতো কনসাল (Consul)।
তারা এক বছরের জন্য রোমের প্রশাসনিক, বিচারিক, সামরিকসহ সব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন। তবে কনসালরা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী পরিষদ সিনেটের (Senate) পরামর্শমতো শাসনকাজ চালাতেন। এক পর্যায়ে রোমানরা প্যাট্রিসিয়ান ও প্লেবিয়ান এ দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ক্রমে অভিজাত প্যাট্রিসিয়ান ও সুবিধাবঞ্চিত শ্রমিক, কৃষকদের নিয়ে গঠিত প্লেবিয়ানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাধে । প্লেবিয়ানরা বিভিন্ন দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন শুরু করে। অবশেষে তাদের মধ্য থেকে ১০ জন ‘ট্রিবিউন’ বা 'ম্যাজিস্ট্রেট' সিনেটের সদস্যপদ লাভ করে। এভাবে রোমে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে।
রোমানরা পরবর্তী সময়ে কার্থেজকে (বর্তমান আলজেরিয়ার অধীনে থাকা প্রাচীন রাজ্য) হারিয়ে পিউনিক যুদ্ধে জয়ী হয় । এ যুদ্ধ খ্রি.পূ. ২৬৪-১৬৪ অব্দে তিনটি পর্বে সংঘটিত হয়। রোমান শাসকেরা স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে শুরু হওয়া দাস বিদ্রোহ দমন করেন । ১১০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের পর রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সুযোগে মারিয়াস, সুলা, পম্পেই ও জুলিয়াস সিজার রোমের ক্ষমতা দখল করেন। তারা প্রত্যেকেই নিজস্ব পদ্ধতিতে সাম্রাজ্যের নানাবিধ সংকট সমাধানের চেষ্টা করেন। অবশেষে জুলিয়াস সিজারের নেতৃত্বে রোমে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সিজারের মৃত্যুর পর (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪ অব্দ) রোমান সাম্রাজ্য অক্টোভিয়ান সিজার, মার্ক এন্টনি ও লেপিডাসের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়।
ইতিহাসে এটি 'ত্রয়ী শাসন' নামে পরিচিত। ক্ষমতা দখল নিয়ে এ তিন শাসকের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এতে জয়ী হন অক্টোভিয়ান সিজার। তিনি 'অগাস্টাস সিজার' উপাধি নিয়ে সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হন। তার সময়ে রোমান সাম্রাজ্য অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায়। অগাস্টাস সিজারের পর রোমান সাম্রাজ্যের ভিত্তি ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে। রোমের শেষ সম্রাট রোমিউলাস অগাস্টুলাসের সময় জার্মান বর্বর জাতি বারবার রোম আক্রমণ করে। রোমিউলাস এ আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হলে ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পতন ঘটে।
রোমান সভ্যতার অবদান
ধর্ম:
প্রজাতন্ত্রের যুগে রোমান ধর্মে নতুন কিছু ছিল না। এ সময় তাদের ওপর গ্রিক ধর্মের প্রভাবই ছিল সক্রিয়। জিউসের মতোই রোমেও আকাশ দেবতা ছিলেন। 'জুপিটার'। গ্রিক দেবী ‘সফেনার' মতো ‘মিনার্ভা' ছিলেন রোমের দেবী। গ্রিক প্রেমের দেবী 'আফ্রদিতি' রোমে এসে হয়েছেন ‘ভেনাস', গ্রিক সাগর দেবতা ‘পসিডন’ রোমে হয়েছেন 'নেপচুন'। সাম্রাজ্যের যুগে ধর্মীয় চিন্তাভাবনা প্রজাতান্ত্রিক যুগের মতোই ছিল। এ সময় প্রচুর মন্দির নির্মাণ করা হয়। খুব ঘটা করে ধর্মীয় উৎসব পালন করা হতো।
অগাস্টাস সিজারের সময় থেকে ঈশ্বররূপে সম্রাটকে পূজা করার রীতি চালু হয়। রোমে নিজস্ব ধর্ম পালনের পাশাপাশি খ্রিষ্টধর্মের বিস্তারও চলতে থাকে। এই নতুন ধর্মে মানুষের প্রতি সম্মান বেশি দেখানো হয়েছিল। তাই অনেকেই খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। রাজশক্তি খ্রিষ্টধর্ম প্রচারে নানাভাবে বাধা দিতে থাকে। সমাজজীবনে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। অবশেষে সম্রাট কনস্ট্যান্টটাইন খ্রিষ্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দিয়েছিলেন।
দর্শন :
দর্শন চর্চার ক্ষেত্রে রোমের সুখ্যাতি ছিল। মূলত গ্রিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করে রোমান দর্শন আত্মপ্রকাশ করে। দার্শনিক লুক্রোটিয়াস ছিলেন ভোগবাদের প্রবক্তা। ‘স্টোয়িকবাদ' হচ্ছে রোমের সবচেয়ে জনপ্রিয় দার্শনিক মতবাদ। স্টোয়িকবাদের উন্নয়নে তিনজন ব্যক্তিত্ব বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন । এদের একজন ছিলেন ধনী রোমান 'সিনেক'। অন্যজন ‘এপিকটেটাস’। তিনি ছিলেন দাস এবং শেষ ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন রোমান সম্রাট ‘মার্কাস অরলিয়াস'। এই দর্শনের মূলকথা হচ্ছে- সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং সত্যবাদী হওয়ার মধ্য দিয়েই সুখলাভ করা।
সাহিত্য:
সাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি লক্ষ করা যায় সম্রাট অগাস্টাস সিজারের সময় থেকে। এ যুগের বিখ্যাত গীতিকবি ছিলেন হোরাস। কবি হিসেবে বিশ্বজোড়া নাম করেছেন ভার্জিল। তার লেখা মহাকাব্য 'ইনিড' বিশ্ববিখ্যাত । অভিদ ও লিভি এ যুগের বিখ্যাত কবি। লিভি একজন ইতিহাসবিদ হিসেবেও খ্যাতিমান। বিখ্যাত বক্তা সিসেরো গদ্যসাহিত্য রচনায় খ্যাতিমান ছিলেন। এ যুগের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক হচ্ছেন প্যাট্রোনিয়াস ও এপুলিয়াস। ব্যঙ্গ কবিতার লেখক জ্যুভেনাল ও ইতিহাসবিদ টেসিটাস ছিলেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে খ্যাতিমান।
স্থাপত্য ও ভাস্কর্য:
স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে রোমানদের উন্নতি সাম্রাজ্যের যুগেই হয়েছিল। রোমান স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে নিজস্ব ধরন দেখা যায়। প্রধানত ইট ও কনক্রিটের স্থাপত্য তৈরি হলেও চৌকোনা পাথর ব্যবহার করা হতো। মার্বেল পাথর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো কনক্রিটের কাঠামো, ইমারতে নানারকম অলংকরণ থাকত। রোমানদের অসাধারণ কীর্তি হচ্ছে তাদের বালিসিয়াম বা স্টেডিয়াম নির্মাণ। রোমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য হচ্ছে সম্রাট হার্ডিয়ানের তৈরি ধর্মমন্দির 'পেনথিয়ন'। 'কলোসিয়াম’ নামে রোমে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নাট্যশালা তৈরি করা হয়েছিল। এর গ্যালারিতে প্রায় ৫০,০০০ দর্শক বসার জায়গা ছিল। রোমান ভাস্কর্যের উদাহরণ হিসেবে প্রচুর মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দেবমূর্তি, সম্রাট এবং বড় বড় কর্মকর্তাদের মূর্তি নির্মাণ করা হতো।
বিজ্ঞান:
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে রোমানদের অবদান খুব উল্লেখযোগ্য নয়। তবে দু-একজন বিজ্ঞানী এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। এদের মধ্যে 'বড় প্লিনী' নামে পরিচিত বিজ্ঞানী বিজ্ঞান বিষয়ে কয়েক খণ্ডে বিশ্বকোষ রচনা করেছিলেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লিখেছিলেন বিজ্ঞানী সেলসাস। এছাড়া ইতালিতে বসবাসকারী কয়েকজন হেলেনিস্টিক বিজ্ঞানী ছিলেন। তারা রোমের বিজ্ঞানের ক্ষেত্রকে পূর্ণতা দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে খ্যাতিমান হচ্ছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানী গ্যালেন। এছাড়া বিজ্ঞানী সোরানাস ও রুফাসের খ্যাতির কথাও জানা যায় ।
ক্ষুদ্রশিল্প:
রোমের বিশাল সাম্রাজ্যজুড়ে নানা ধরনের শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছিল। এখানে তৈরি হতো অস্ত্রশস্ত্র, ব্রোঞ্জ এবং লোহার দ্রব্যাদি এবং পশমি বস্ত্র ও মাটির পাত্র ।
আইন:
আইনের ক্ষেত্রে রোমান সভ্যতার বিশেষ কৃতিত্ব ছিল । প্রথম দিকে রোমান আইনের কোনো লিখিত রূপ ছিল না। ৪৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ১২টি ব্রোঞ্জপাতে সর্বপ্রথম রোমান আইন সংকলিত হয় । রোমান আইনে মানুষের প্রতি সম-অধিকারের কথা বলা হয়েছে। আইনের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি ঘটে সাম্রাজ্যের যুগে। অগাস্টাস সিজার ও তার উত্তরাধিকারীদের পৃষ্ঠপোষকতায় রোমান আইনের তিনটি শাখা বিকাশ লাভ করে। এগুলো হচ্ছে—
১. বেসামরিক আইন: এ আইনগুলো পালন করতে নাগরিকরা বাধ্য ছিল। লিখিত ও অলিখিত দু প্রকার বেসামরিক আইন চালু ছিল ।
২. জনগণের আইন: মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার রক্ষার জন্য এ আইন তৈরি করা হয়েছিল । এই আইনের জনক ছিলেন সিসেরো।
৩. প্রাকৃতিক আইন: স্টোয়িক মতবাদভিত্তিক এই আইনের বক্তব্য হচ্ছে, প্রকৃতিগতভাবেই সব মানুষ সমান এবং জন্মগতভাবে লাভ করা তাদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করার ক্ষমতা সরকারের নেই। সিসেরো ছিলেন এই আইনের জনক।
রোমান সাম্রাজ্যের শাসন যুগে প্রচলিত আইনগুলোর ভুল সংশোধন করার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন সম্রাট হার্ডিয়ান। রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংস হওয়ার পর পূর্ব রোমে নতুনভাবে রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। সাধারণভাবে এটিকে বলা হতো 'বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য'। এ সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাট জাস্টিনিয়ান সম্পূর্ণ রোমান আইন সংকলন করেছিলেন। প্রয়োজনীয়তার তারতম্য বিবেচনা করে একপর্যায়ে রোমান আইনের পুনর্বিন্যাস করা হয়। রোমান আইন দাসদের প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ ছিল। এ আইন ছিল নিরপেক্ষ, উদার এবং মানবিক। এখানে বিধবা ও এতিমদের অধিকার রক্ষার ব্যবস্থাও ছিল।