উমাইয়া শাসন সুদৃঢ়ীকরণে আব্দুল মালিকের অবদান মূল্যায়ন কর
ভূমিকা:
মুয়াবিয়া (রা.) কর্তৃক উমাইয়া বংশের সূচনা হয় এবং মারওয়ান পুত্র আব্দুল মালিকের শাসনামলে তা পূর্ণতা লাভ করে। অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও বহির্শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করে আব্দুল মালিক উমাইয়া সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করেন। । ঐতিহাসিক আমির আলি তাঁর সম্পর্কে বলেন, "Abdul Malik was energetic, intriguing, and unscrupulous, he applied himself with extraordinary ability to strengthen his position." [A Short History of the Saracens, P- 93] এজন্যই আব্দুল মালিককে উমাইয়া বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক বলা হয়।
উমাইয়া শাসন সুদৃঢ়ীকরণে আব্দুল মালিকের অবদান : নিম্নে উমাইয়া শাসন সুদৃঢ়ীকরণে আব্দুল মালিকের অবদান মূল্যায়ন করা হলো :
১. আল মুখতারের বিদ্রোহ দমন :
মুখতার ছিলেন শিয়া মতাবলম্বী । কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসেনের হত্যাকাণ্ডের ফলে তিনি উমাইয়াদের ওপর প্রতিশোধ নিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। এদিকে বসরার শাসনকর্তা মুসয়াবের সাথে মুখতারের বিরোধ বাধে। অবশেষে মুসয়াবের সেনাপতি মুহাল্লিবের হাতে মুখতার নিহত হন । ফলে আব্দুল মালিকও আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পান ।
২. মুসয়াবের বিদ্রোহ দমন :
মুখতারকে হত্যার পর আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের ভ্রাতা মুসয়াব খলিফা আব্দুল মালিকের বিরুদ্ধাচরণ করেন। ৬৯১ খ্রিস্টাব্দে খলিফা নিজে অভিযান করে মুসয়াবকে পরাজিত ও হত্যা করেন। ফলে ইরাকে উমাইয়া আধিপত্য নিষ্কণ্টক হয় ।
৩. আব্দুল্লাহ বিন জুবায়েরের বিদ্রোহ দমন :
মুসয়াবের পতনের পর উমাইয়া সিংহাসনের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী হিজাজের খিলাফতের দাবিদার প্রসিদ্ধ সাহাবি আব্দুল্লাহ বিন জুবায়েরের বিরুদ্ধে আব্দুল মালিক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। ৭ মাস অবরুদ্ধ করার পর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ নৃশংসভাবে আবদুল্লাহ বিন জুবায়েরকে হত্যা করেন।
৪. খারিজি বিদ্রোহ দমন :
কারবালার হত্যাকাণ্ড, উমাইয়াদের অত্যাচার ও হাজ্জাজের নৃশংসতার বিরুদ্ধে ইরাক ও দক্ষিণ পারস্যে খারিজিগণ উমাইয়াবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন এবং বহুবার খলিফার বাহিনীকে পরাজিত করেন। কিন্তু খারিজিদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও মতানৈক্যের সুযোগে মুহাল্লিব ৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। পরবর্তীতে খারিজিগণ নাফি বিন আখতালের নেতৃত্বে পুনরায় বিদ্রোহ ঘোষণা করলে হাজ্জাজ অস্ত্রধারণ করে আখতালসহ বহু খারিজিকে হত্যা করেন ।
৫. রোমানদের প্রতিহতকরণ :
খারিজিদের মতো রোমানরাও গৃহযুদ্ধের সুযোগে ৬৮৯ খ্রিস্টাব্দে সন্ধিভঙ্গ করে উমাইয়া সাম্রাজ্যে অনধিকার প্রবেশ করলে খলিফা আব্দুল মালিক বাহিনী অভিযান করে এন্টিয়ক পুনরুদ্ধার করেন এবং দক্ষিণ আর্মেনিয়া ও সাইপ্রাস দখল করেন। ৭০৩ খ্রিস্টাব্দে খলিফার বাহিনী এশিয়া মাইনরে বহু দুর্গ দখল করেন ।
৬. জানবিলের বিরুদ্ধে অভিযান :
সিজিস্তানের রাজা জানবিল কাবুল থেকে কান্দাহার পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চলে স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করলে, এটা মুসলিম সাম্রাজ্যের স্বার্বভৌমত্বে আঘাত হানে। ফলে হাজ্জাজ কর্তৃক প্রেরিত আল আসাদের নেতৃত্বে ‘ময়ূর বাহিনী' জানবিলকে পরাজিত ও বিতাড়িত করে হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করে ।
৭. গোত্রীয় কলহ দমন :
এ সময় হিমারীয় মুদারীয়, কায়েস ও কালব, বনু তাঘলিব, বনু কালব প্রভৃতি গোত্র ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষে উমাইয়া কেন্দ্রীয় শক্তিকে দুর্বল করে ফেললে আব্দুল মালিক কঠোর হস্তে এসব গোত্রীয় কলহ নির্মূল করেন।
৮. আফ্রিকা পুনরুদ্ধার :
৬৯৩ খ্রিস্টাব্দে আব্দুল মালিকের সেনাপতি জোহাইর বার্বার ও রোমান দলপতি কুসায়েরকে পরাজিত করে কায়রোয়ান পুনঃদখল করেন। কিন্তু বার্বার ও রোমানদের সম্মিলিত বাহিনীর অতর্কিত হামলায় জোহাইর নিহত হন। পরবর্তীতে আব্দুল মালিক সেনাপতি হাসানের নেতৃত্বে আরেকটি শক্তিশালী অভিযান প্রেরণ করেন। সেনাপতি হাসান ৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে কার্থেজ, বাকা, কায়রোয়ান জয় করে আটলান্টিকের উপকূল পর্যন্ত জয় করেন।
৯. শাসনব্যবস্থায় আরবিকরণ :
আব্দুল মালিকের শাসনকালের প্রশ্ন ৪ অন্যতম কৃতিত্ব হলো আরবি ভাষার জাতীয়করণ। তিনি সমগ্র অথবা, উ রাজ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার পরিবর্তে আরবি ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। সরকারি অফিস আদালতে আরবি ভাষার প্রচলন করা হয় এবং কাগজপত্র আরবি ভাষায় সংরক্ষণের নিয়ম চালু হয় ।
১০. আরবি মুদ্রার প্রচলন :
রাষ্ট্রভাষা আরবিকরণের পর আব্দুল মালিক আরবি মুদ্রা চালুর চিন্তা করেন। ৬৯৬-৬৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রশংসনী আব্দুল মালিক দামেস্কে একটি জাতীয় টাঁকশাল স্থাপন করে সম্পূর্ণ আরবি অক্ষরযুক্ত নির্দিষ্ট ওজন ও সর্বজনস্বীকৃত একক মুদ্রামানের তিন ধরনের মুদ্রা চালু করেন। ঐতিহাসিক P. K. Hitti বলেন, "Abd-al-Malik Struck at Damuscus, in 695, the first gold dinars and silver dirhams which were purely Arabic." [History of the Arabs, P-217]
১১. ডাক বিভাগের সংস্কার :
আব্দুল মালিক ডাক বিভাগের সংস্কার করেন। রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ চিঠি সরবরাহের পাশাপাশি এ বিভাগ গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করতো। ডাক বিলি ও সংগ্রহের সাথে সাথে ডাক কর্মচারীরা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সংগ্রহ ও সরবরাহ করতো ।
১২. রাজস্ব সংস্কার :
আব্দুল মালিকের শাসনামলে যে মাওয়ালিরা গ্রাম থেকে শহরে এসেছিল, তাদেরকে গ্রামে ফিরে গিয়ে পতিত জমি চাষাবাদ করতে বাধ্য করেন । তাদের কাছ থেকে বাধ্যতামূলক জিজিয়া ও খারাজ আদায় করা হয় । তার এ নীতির ফলে রাষ্ট্রের অর্থব্যবস্থা আসন্ন ধ্বংস থেকে রক্ষা পায়।
১৩. স্থাপত্যশিল্পের উন্নতি :
উমাইয়া
খলিফাদের মধ্যে আব্দুল মালিক ছিলেন স্থাপত্যশিল্পের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। আব্দুল
মালিক জেরুজালেমে ‘কুব্বাতুস সাখরা' নির্মাণ করেন । এছাড়াও তিনি নতুন নতুন শহর গড়ে
তোলেন। তিনি 'দিওয়ানুল রাসায়েল' স্থাপন করেন ।
উপর্যুক্ত
আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক তাঁর সাহস,
রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও কর্মদক্ষতা দ্বারা উমাইয়া খিলাফতের ভিত্তিকে মজবুত করেন।
পরবর্তীতে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরিরাও উমাইয়া সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় করে সাম্রাজ্যের
সীমানা আটলান্টিকের তীর পর্যন্ত বিস্তৃত করতে সক্ষম হন। তাই আব্দুল মালিককে
উমাইয়াদের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক বলা হয়। ঐতিহাসিক P. K. Hitti বলেন, "Under
Abdul Malik's rules and that of the four sons who succeeded the dynasty at
Damascus reached the meridian of its power and glory." [History of the
Arabs, P206]
আব্দুল মালিকের আরবিকরণ নীতি : নিম্নে আব্দুল মালিকের আরবিকরণ নীতি আলোচনা করা হলো :
১. প্রশাসনিক ব্যবস্থা আরবিকরণ :
খলিফা আব্দুল মালিক আরব জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে শাসনব্যবস্থা আরবিকরণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এতদিন ইরাক ও পারস্যে পাহলভি ভাষা, দামেস্কে গ্রিক এবং বিভিন্ন প্রদেশে আঞ্চলিক ভাষার প্রচলন ছিল। কিন্তু খলিফা আব্দুল মালিক ৯৯৬-৯৭ খ্রিস্টাব্দে এক অধ্যাদেশ জারি করেন যে, ভারসাম্যপূর্ণ শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য এখন থেকে সমগ্র উমাইয়া সাম্রাজ্যে 'আরবি' ই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর ফলে সব আঞ্চলিক ভাষার পরিবর্তে সরকারি কাগজপত্র, দলিল দস্তাবেজ, অফিস আদালতে আরবি ভাষা সংরক্ষিত হতে থাকে ।
২. একক আরবি মুদ্রার প্রচলন :
আরবিকরণের দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে আব্দুল মালিক আরবি মুদ্রা প্রচলনের পরিকল্পনা করেন । এ লক্ষ্যে তিনি একটি জাতীয় টাঁকশাল স্থাপন করেন। ৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে দামেস্কে এ টাকশাল স্থাপিত হয়। এই টাঁকশাল থেকে সম্পূর্ণ আরবি অক্ষরযুক্ত নির্দিষ্ট এবং সর্বজন স্বীকৃত একক মুদ্রামানের দিনার, দিরহাম ও ফালুস ছাপেন। সমগ্র সাম্রাজ্যে এই মুদ্রা দ্বারাই বেচাকেনার নির্দেশ জারি করেন।
৩. আরবি বর্ণমালার উৎকর্ষ সাধন :
খলিফা আব্দুল মালিকের আরবিকরণ নীতি বাস্তবায়নের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো আরবি বর্ণমালার উচ্চারণ ও লিখন পদ্ধতির উৎকর্ষসাধন । ইতিপূর্বে আরবি বর্ণমালায় হরকত ও নোকতার ব্যবহার ছিল না। এতে অনারব মুসলমানদের পক্ষে আরবি পড়া কষ্টকর ছিল। এ অবস্থা নিরসনকল্পে আব্দুল মালিক তার অভিজ্ঞ উপদেষ্টা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পরামর্শ ও তত্ত্বাবধানে আরবি বর্ণমালায় নোকতা ও হরকত সংযুক্ত করেন। ফলে আরব অনারব সব মুসলমানের পক্ষে নির্ভুলভাবে আরবি পড়া সহজ হয় ।
৪. আরবদের চাকরিতে নিয়োগ :
খলিফা আব্দুল মালিক কর্তৃক আরবি ভাষা রাষ্ট্রীয়করণের ফলে আরবি ভাষা জানা লোকদের চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। ইরাক, সিরিয়া, মিসর পারস্যের অনারবি কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা হয় এবং এর স্থলে আরবি জানা লোকদের চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয় ।
৫. ডাক ব্যবস্থায় আরবিকরণ :
উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়া (রা.)-এর শাসনামলে ডাক বিভাগের প্রচলন হয়। আব্দুল মালিক এই ডাক বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করেন। ডাক বিভাগকে গতিশীল করার জন্য তিনি বদলি ঘোড়ার ব্যবস্থা চালু করেন। এখানে তিনি আরবি ব্যবহার নিশ্চিত করেন। চিঠিপত্র লেখা, আদানপ্রদান ও রেজিস্ট্রির ভাষা ছিল আরবি।
৬. বিচার বিভাগ আরবিকরণ :
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য খলিফা আব্দুল মালিক একটি নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন । কোরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস তথা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য তিনি বিভিন্ন প্রদেশের কাজিদের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার ব্যবস্থা করেন। এ আপিলের ভাষা ছিল আরবি। যাতে কাজিউল কুজ্জাত ফরিয়াদির মনের কথা বুঝতে পারেন । সেজন্যই এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় ।
৭. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিভাগ আরবিকরণ :
খলিফা আব্দুল মালিক সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে মাদ্রাসা, মক্তব, স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার প্রধান বাহন হিসেবে আরবিকে ব্যবহারের নির্দেশ দেন। ফলে তৎকালীন উমাইয়া সাম্রাজ্যে বহু আরবি কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, জ্ঞানী ও পণ্ডিতের আবির্ভাব ঘটে। তারা আরবিকে তৎকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন ।
৮. রেজিস্ট্রি বিভাগ আরবিকরণ :
খলিফা আব্দুল মালিক সরকারি কাগজপত্র, দলিল দস্তাবেজ, সংরক্ষণের জন্য দিওয়ান উল রাসায়েল বা রেজিস্ট্রি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। এ বিভাগকেও আরবিতে তাদের কার্যক্রম পরিচালনের নির্দেশ প্রদান করেন ।
৯. স্থাপত্যশিল্পে আরবিকরণ :
আব্দুল মালিক মসজিদে আল আকসা সংস্করণ 'Dome of the Rock' 'কুব্বাতুস সাখরা' ও আল ওয়াসিত শহর নির্মাণে আরবিয় পদ্ধতির অনুসরণ করেন।
উপর্যুক্ত
আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক আরবি ভাষার প্রচলন
আরবি মুদ্রার প্রবর্তন, ডাক, বিচার, রাজস্ব প্রতিটি ক্ষেত্রেই আরবি বাষা ব্যবহার
করে প্রশাসনের সর্বত্রই আরবিকরণ নীতি গ্রহণ করেন । আব্দুল মালিক আরব জাতীয়তাবাদকে
সুদূরপ্রসারী করার জন্য প্রশাসনের সর্বস্তরে আরবি ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করেন।
প্রভাবশালী উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিকের একক প্রচেষ্টায় তৎকালীন বিশ্বে ভাষা
হিসেবে আরবি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করতে সক্ষম হয় ।