খলিফা হিশামের চরিত্র ও কৃতিত্ব আলোচনা কর।

  

খলিফা হিশামের চরিত্র ও কৃতিত্ব আলোচনা কর


খলিফা হিশামের চরিত্র ও কৃতিত্ব আলোচনা কর।

ভূমিকা :

উমাইয়া বংশের শেষ শ্রেষ্ঠ শাসক হিশাম ইবনে আব্দুল মালিক দ্বিতীয় ইয়াজিদের মৃত্যুর পর ৭২৪ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করে রাজ্যের সীমানা বর্ধিত করায় মনোযোগ দেন। তার শাসনামলে ইসলামি রাজ্যের সীমানা বহুদূর বিস্তৃত হয়। তার শাসনব্যবস্থা, দক্ষতা, কৃতিত্ব ও সফলতা পর্যালোচনা করে ঐতিহাসিকগণ তাকে উমাইয়া বংশের শেষ শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর উমাইয়া বংশের স্বর্ণযুগের অবসান ঘটে। ঐতিহাসিক P.K. Hitti বলেন, "With Hisham (724-43) the fourth son of Abd-Al-Malik, the Umayyad golden age came to close." [History of the Arabs; P-222]

শেষ শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে উমাইয়া খলিফা হিশামের শাসননীতি ও কৃতিত্ব : নিম্নে শেষ শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে উমাইয়া খলিফা হিশামের শাসননীতি ও কৃতিত্ব বর্ণনা করা হলো :


১. হিমারীয়দের পৃষ্ঠপোষকতা:

উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় ইয়াজিদের শাসনামলে তারই পৃষ্ঠপোষকতায় মুদারীয়রা অত্যন্ত ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। তাদের ক্ষমতা খর্ব করতে হিশাম সিংহাসনে আরোহণ করে হিমারীয়দের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তিনি হিমারীয় গোত্রের খালিদ বিন আব্দুল্লাহ আল বসরিকে ইরাকের এবং খালিদের ভাই আসাদ আল হোবায়রাকে খোরাসানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন ।

২. ইরাকের বিদ্রোহ দমন:

হিমারীয় বংশের শাসক খালিদ ইরাকের শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়ে কৌশলে হিমারীয় মুদারীয় দ্বন্দ্ব প্রতিহত করেন। তার সময়ে খারিজিরা বিদ্রোহ করলে তিনি খারিজিদের কঠোর হস্তে দমন করেন। দীর্ঘ পনের বছর কৃতিত্বের সাথে শাসন পরিচালনা করলেও অর্থ আত্মসাৎ ও আলি (রা.) এর সমর্থকদের প্রতি বিশেষ অনুরক্তের অভিযোগে খালিফা তাকে পদচ্যুত করেন। ৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে আলি বংশীয় জায়েদ নিজেকে খলিফা ঘোষণা করলে নবনিযুক্ত শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তাকে পরাজিত ও হত্যা করেন।

৩. খোরাসানের বিদ্রোহ দমন:

যেহেতু মুসলমানদের জিজিয়া কর দিতে হতো না। তাই জিজিয়া থেকে মুক্তি লাভের আশায় সাগোদের অধিবাসীগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে নওমুসলিমদের ওপর জিজিয়া ধার্য করলে তারা হারিসের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে । বিদ্রোহীদের আবেদনে খাকানের নেতৃত্বে তুর্কিরাও এগিয়ে আসে। ৭৩৮ খ্রিস্টাব্দে খোরাসানের শাসনকর্তা আসাদ আল কাসরি খাকানকে এক যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করে বিদ্রোহ দমন করেন ।

৪. খাজারদের বিদ্রোহ দমন:

খাজার সম্প্রদায়ের তুর্কিগণ ককেশীয় পর্বতের উত্তরে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানে বসবাস করতো। ৭২৭ খ্রিস্টাব্দে তারা আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান আক্রমণ করলে সেখানকার গভর্নর পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। ৭৩১ খ্রিস্টাব্দে তারা মসুল আক্রমণ করে সেখানকার গভর্নর জাররাকে পরাজিত ও নিহত করেন। এ সংবাদ পেয়ে খলিফা হিশাম সাইদ আল হাবশিকে বিপুল সৈন্যসহ খাজারদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন । খাজারগণ তার নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন ।

৫. উত্তর আফ্রিকার বিদ্রোহ দমন:

উত্তর আফ্রিকার বার্বারদের সহযোগিতায় সেখানকার খারিজিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ৭৩৮ খ্রিস্টাব্দে তারা তাঞ্জিয়ার শাসনকর্তাকে হত্যা করে রাজধানী কায়রোয়ান আক্রমণ করেন। পরবর্তীতে সেনাপতি খালিদ বিন হাবিবকেও পরাজিত ও হত্যা করেন। অবশেষে কায়রোয়ানের শাসনকর্তা হানজালা বিন সাফওয়ান ৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে বার্বার ও খারিজিদের পরাজিত করে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেন।

৬. গ্রিকদের প্রতিরোধ:

গ্রিকরা এশিয়া মাইনরে গোলযোগ সৃষ্টি করলে আলু বাত্তাল নামক একজন আরব সেনাপতি তাদের প্রতিরোধ করেন। অবশ্য এর পূর্বে খলিফার দুই পুত্র গ্রিকদের প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছিল।

৭. ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ জয়:

খলিফা হিশাম নৌবাহিনীর সাহায্যে ৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ সার্ডিনিয়া দখল করেন এবং ৭৩৯-৪০ খ্রিস্টাব্দে সিসিলি দ্বীপের রাজধানী সাইরিকাশ অধিকার করেন। 

৮. আব্বাসি বিদ্রোহ:

হিশামের খিলাফতকালে আফ্রিকা ও স্পেনে বিশৃঙ্খলার সুযোগে আব্বাসিগণ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ সময় আবু মুসলিম খোরাসানি নামক জনৈক ব্যক্তি আব্বাসের  বংশধর মুহম্মদ এবং তার পুত্র ইব্রাহিমের পক্ষে খোরাসানে প্রচার কার্য চালাতে শুরু করেন। খলিফা এ আন্দোলন দমন করতে ব্যর্থ হন। কালক্রমে এ আন্দোলন উমাইয়া বংশের ধ্বংস মুক্তিপ্রাপ্ত সাধন করে।

৯. খ্রিস্টানদের প্রতি উদারতা : 

হিশাম খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের প্রতি সদয় ছিলেন। এর ফলে খ্রিস্টান ধর্মযাজক স্টিকেনাসের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। আর খ্রিস্টান সংগীতজ্ঞ হুনায়ন আল হিরি তার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে ।

১০. সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক:

তিনি যেমন যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, সাহিত্যানুরাগী ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায়ও তিনি ঐরূপ সুনাম অর্জন করেছিলেন। তার প্রধানমন্ত্রী সেলিম একজন ভাষাবিদ ছিলেন। এছাড়াও তার দরবারে অনেক জ্ঞানী ও বিদ্বানদের সমাগম হতো ।

১১. চরিত্র:


খলিফা হিশাম ইবনে আব্দুল মালিক বহুমুখী শ্রেণি তিনি অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ, চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তিনি অত্যন্ত বিদ্যানুরাগী, বিচক্ষণ শাসক ছিলেন। রাজ্য বিস্তারে তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এতৎসত্ত্বেও তিনি ছিলেন সংকীর্ণমনা, সন্দেহপ্রবণ, লোভী ও ষড়যন্ত্রকারী।

উপসংহার :

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, হিশাম ছিলেন উমাইয়া বংশের শ্রেষ্ঠতম শাসকদের একজন। শতপ্রতিকূলতার মাঝেও সিংহাসনে আরোহণ করে তিনি যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা তাকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন করেছে। বিদ্রোহ দমন এবং রাজ্য বিস্তারসহ প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তিনি যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে তার শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় বহন করে। এজন্যই ঐতিহাসিক P. K. Hitti বলেন, "After Muawiyah and Abdul Malik, Hisham was rightly considered by Arab authorities the third and last statesman of the house of Umayyah." [History of the Arabs; P-222]

 

 

 


Post a Comment

Previous Post Next Post