বেকারত্ব কী? বাংলাদেশে বেকারত্ব দূরীকরণের উপায়সমূহ আলোচনা কর।
ভূমিকা:
বেকারত্ব বিশ্বব্যাপী সবদেশের প্রধান আর্থসামাজিক সমস্যা। বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির এক-তৃতীয়াংশ বেকার রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। উচ্চশিক্ষিত যুবক-যুবতীদের মধ্যেও সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বেকার। আবার কর্মে নিযুক্ত শ্রমিকদের একটি বড় অংশ অর্ধ বেকার ও প্রচ্ছন্ন বেকার। বেকারত্বের প্রভাবে উন্নয়নের প্রাথমিক উপাদান মানবসম্পদের ব্যাপক অপচয় ঘটে।
বেকারত্ব:
সাধারণত কর্মক্ষম ব্যক্তির কাজের অভাবে কর্মহীন থাকাকে বেকারত্ব বলে। যদি কেউ কাজ থাকা সত্ত্বেও কাজ না করে তাকে বেকার বলা যায় না। অর্থনীতিতে বেকারত্ব বলতে এমন পরিস্থিতিতে বুঝায় বহুসংখ্যক শ্রমিক প্রচলিত মজুরিতে কাজ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে কিন্তু যোগ্যতানুসারে কাজ পায় না। সমাজে অনেক কর্মক্ষম লোক আছে যারা বর্তমান প্রচলিত মজুরিতে কাজ করতে ইচ্ছুক নয়, তাদের বেকার বলা যায় না।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা:
অধ্যাপক পিগু বলেন, "যখন কোনো দেশে কর্মক্ষম শ্রমিকেরা প্রচিলত মজুরিতে কাজ করতে ইচ্ছুক থাকা সত্ত্বেও যোগ্যতানুযায়ী কাজ পায় না, তখন সেই অবস্থাকে বেকারত্ব বলে।"
সমাজবিজ্ঞানী ম্যামোরিয়া বলেন, “বেকারত্ব হলো কর্মক্ষম লোকের কর্মহীনতা। এটি তাদের অনিচ্ছাকৃত, ইচ্ছাকৃত অলসতা নয়।"
জে.এম.কেইনসের ভাষায়, “বেকারত্ব বলতে প্রধানত অনিচ্ছাকৃত কাজ না পাওয়াকেই বুঝায়।”
Encyclopedia of Britannica
তে বেকারত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, “কোনো ব্যক্তি কাজ করতে সমর্থ কিন্তু কাজ খুঁজে
পায় না, ব্যক্তির এ অবস্থাকে বেকারত্ব বলে।”
বাংলাদেশে বেকার সমস্যা নিরসনের উপায়:
বাংলাদেশে বেকার সমস্যা একটি মারাত্মক জাতীয় হুমকি, যার নেতিবাচক প্রভাব সুদূরপ্রসারী । তাই বাংলাদেশের বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। নিম্নে বাংলাদেশের বেকার সমস্যা সমাধানের উপায়সমূহ আলোচনা করা হলো-
১. জনসংখ্যাধিক্য রোধ:
বাংলাদেশে জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু সে হারে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তাই বাংলাদেশের বেকার সমস্যা সমাধানকল্পে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার রোধ করতে এখনই কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
২. দ্রুত শিল্পায়ন:
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের বহু শিল্পকারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে। সেগুলোর যথাযথ মেরামত এবং পাশাপাশি কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক । অধিক সংখ্যক কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে এদেশের বেকার সমস্যা অনেকখানি লাঘব করা সম্ভব।
৩. ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প গঠন:
দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার্থে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এতে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে দেশীয় পণ্যের কদর বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে দেশের বেকারত্বের পরিমাণও হ্রাস পাবে।
৪. নারী শিক্ষার প্রসার:
দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। এই অর্ধেক জনসংখ্যাকে কর্মহীন রেখে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির বিধান নিশ্চিত করা কখনোই সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশের নারী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে যাতে নারীরা শ্রমশক্তি হিসেবে উৎপাদনমুখী কার্যক্রমে নিয়োজিত হতে পারে।
৫. কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি:
মৌসুমভিত্তিক চাষাবাদের ফলে অনেক কৃষকই বছরের একটি দীর্ঘ সময় বেকার সমস্যায় জর্জরিত হন। তাই কৃষিক্ষেত্রে চাষাবাদ পদ্ধতি পরিবর্তন ও একাধিক ফসল ফলানোর ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তারা বছরের অন্যান্য সময় বেকার হয়ে না পড়ে।
৬. দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি:
বিশ্বের উন্নত এমন অনেক দেশ আছে যেখানে কর্মের অভাব নেই, কিন্তু দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে আমাদের দেশে যেহেতু ব্যাপক জনসংখ্যা রয়েছে, তাই তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করে বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থানের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যেতে পারে । এর ফলে বেকার সমস্যারও সমাধান করা যাবে।
৭. জাতীয় নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন:
বাংলাদেশের বেকার সমস্যা সমাধানকল্পে জাতীয় থেকে স্থানীয় পর্যায়ে একটি সুষ্ঠ নীতিমালা অনুসরণ করা প্রয়োজন। আর এই নীতিকে জাতীয় নীতিমালার সাথে সমন্বিত করে সর্বস্তরের উদ্দেশ্যে প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য কর্মপরিকল্পনা প্রদান করতে হবে। এতে বেকার সমস্যাকে সুপরিকল্পিত উপায়ে সমাধান করা সম্ভব হবে।
৮. কারিগরি শিক্ষার প্রসার:
আমাদের
দেশে শুধুমাত্র তাত্ত্বিক শিক্ষা প্রদানের ফলে ছাত্রছাত্রীগণ পড়াশুনা শেষে কারিগরি
শিক্ষার অভাবে যোগ্যতানুযায়ী চাকরি পায় না। ফলে বেকার সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে।
এজন্য কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। তাহলেই দেশের জনশক্তি দক্ষ হয়ে উঠবে এবং
দেশে প্রযুক্তিগত বেকারত্ব দূর হবে।
You May also like: প্রাচীন বাংলার জনপদগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও
৯. নারীদের মূল্যায়ন:
পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় এ দেশের নারীরা তাদের কর্মের যথাযোগ্য মূল্যায়ন পায় না বিধায় তারাও বেকারের কাতারে পড়ে। তাই বাংলাদেশে বিদ্যমান বেকার সমস্যার সমাধান করতে হলে নারীদের কর্মমূল্যায়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
১০. দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন:
দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতার দরুন অনেকেই কাজের মাঝে ছোট-বড় নানা বিভাজন তৈরি করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোনো কাজই ছোট নয়; বরং যেকোনো কাজের মাধ্যমে মানুষ নিজ অবস্থান আরও মর্যাদাসম্পন্ন করতে পারে। তাই বাংলাদেশের বেকার সমস্যার সমাধান করতে হলে বাংলাদেশের জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। কোনো কাজকেই জনগণ যাতে ছোট করে না দেখে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে ।
১১. আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা:
আমাদের দেশে লেখাপড়া শেষ করে শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা চাকরির প্রতি মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে । ফলে শুধুমাত্র চাকরি ব্যতীত অন্য কোনো উপায়ে জীবিকানির্বাহে তার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু এই ত্রুটিপূর্ণ মানসিকতা পরিবর্তন করে তাদের মাঝে আত্মকর্মসংস্থান তৈরির স্পৃহা জাগাতে পারলে এদেশে বেকার সমস্যা অনেকটাই লাঘব হবে।
১২. লাভজনক শিল্প স্থাপন:
মূলধনের
অভাবে এদেশে এমন অনেক শিল্প গড়ে উঠেছে যা অলাভজনক। বাংলাদেশ ও বিদেশি উদ্যোগে
লাভজনক শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে এবং অলাভজনক শিল্পকারখানাগুলো পরিহার করতে
হবে। এতে অলাভজনক শিল্পে ছাঁটাইয়ের ফলে সৃষ্ট বেকারত্বের সংখ্যা কমবে।
You
May also like: সামাজিক প্রতিষ্ঠান বলতে কী বুঝ?
উপসংহার:
উপর্যুক্ত
আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বেকারত্ব শুধু একটি সমস্যাই নয়, এটি অন্যান্য
আর্থসামাজিক সমস্যার কারণও বটে । বেকারত্বের ফলে উৎপাদন হ্রাস পায় এবং মাথাপিছু
আয় কমে সঞ্চয় হ্রাস পায়। সঞ্চয় হ্রাস পেলে বিনিয়োগ কমে। ফলে শ্রমের চাহিদা
হ্রাস পেয়ে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। এভাবে সৃষ্ট বেকারত্বের চক্রাকার প্রভাব
সামাজিক বিভিন্ন সমস্যার উদ্ভব ঘটায় ।