হযরত ওসমান (রা.)-এর হত্যার কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর।

 

হযরত ওসমান (রা.)-এর হত্যার কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর।

হযরত ওসমান (রা.)-এর হত্যার কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর।

ভূমিকা : 

হযরত ওসমান (রা.) ছিলেন খোলাফায়ে রাশেদুনের তৃতীয় খলিফা। খলিফা হযরত ওমর (রা.)-এর মৃত্যুর পর ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দীর্ঘ বারো বছর (৬৪৪-৬৫৬ খ্রি.) তিনি অত্যন্ত সুচারুরূপে খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু প্রথম হয় বছর শাসনের পর একদল পথভ্রষ্ট মুসলিম বিদ্রোহীর দাবানলে সমগ্র সাম্রাজ্যে অরাজকতার সৃষ্টি হয় । যার পরিণামে বিদ্রোহীরা। অত্যন্ত সুকৌশলে নির্মমভাবে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা.)-কে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুন হত্যা করে ।


হযরত ওসমান (রা.)-এর হত্যার কারণ ও ফলাফল: নিম্নে হযরত ওসমান (রা.)-এর হত্যার কারণ ও ফলাফল আলোচনা করা হলো :


হযরত ওসমান (রা.)-এর হত্যার কারণ :

নিম্নে হযরত ওসমান (রা.)-এর হত্যার কারণ আলোচনা করা হলো :


১. উমাইয়া-হাশেমি দ্বন্দ্ব:

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মের বহু পূর্ব থেকে উমাইয়া-হাশেমি বংশের সংঘাত শুরু হয়েছে। হযরত ওসমান (রা.)-এর খিলাফত গ্রহণের মাধ্যমে উমাইয়ারা ক্ষমতাসীন হলে এ দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক আমির আলি বলেছেন, হযরত ওসমানের সময়ে হাশেমি ও উমাইয়া গোত্রের মধ্যে যে চরম শত্রুতা আরম্ভ হয়, তা এক শতাব্দীর অধিককাল চলে ।


২. স্বজনপ্রীতি:

হযরত ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কারণ ছিল স্বজনপ্রীতি । তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহীরা অভিযোগ করে যে, তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে তার আত্মীয়স্বজনদের নিযুক্ত করেন। যদিও এ অভিযোগের কোনো ভিত্তি ছিল না। তবুও এ অভিযোগের কারণে তার হত্যাকাণ্ড ত্বরান্বিত হয় ।


৩. আবুজর আল গিফারির নির্বাসন:

 হযরত ওসমান (রা.)-এর খিলাফতকালে বিশিষ্ট সাহাবি আবু জর আল গিফারির সম্পদ সম্পর্কিত প্রচারণা নিয়ে অপরাপর সাহাবিদের সাথে তার বিরোধ সৃষ্টি হয়। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে হযরত ওসমান (রা.) তাঁকে মদিনায় বসবাস করার প্রস্তাব করলে আবু জর আল গিফারি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং রাবাধায় চলে যান। দুর্ভাগ্যক্রমে মাত্র দুই বছরের মধ্যে তিনি রাবাধায় মৃত্যুবরণ করলে বিদ্রোহীরা আবু জর আল গিফারির মৃত্যুর জন্য হযরত ওসমান (রা.)-কে দায়ী করতে থাকে, যা তার হত্যাকাণ্ডের অন্যতম একটি কারণ।


৪. হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-কে সুবিধা প্রদান:

হযরত ওসমান (রা.)-এর একজন নিকটাত্মীয় ছিলেন সিরিয়ার শাসনকর্তা হযরত মুয়াবিয়া (রা.)। হযরত ওসমান (রা.)-এর শাসনকালে তিনি সিরিয়ার সব সরকারি ভূসম্পত্তি ও জাতীয় সম্পদ ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করেন।-এর ফলে লোকেরা খলিফাকে দোখারািপ করতে থাকলে বিদ্রোহ দানা বাধে ।


৫. কাবা শরিফ সম্প্রসারণ:

হযরত ওসমান (রা.)-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে, তিনি কাবাশরিফ সম্প্রসারণের জন্য জমি দখল করে তার ক্ষতিপূরণ দেননি। কিন্তু এ অভিযোগটি ছিল সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। হযরত ওমর (রা.)-এর সময় কাবা সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়, পরে হযরত ওসমান (রা.) তা শেষ করেন। হযরত ওমর (রা.) দখলকৃত জমির ক্ষতিপূরণ দেওয়ার চেষ্টা করলে জমির মালিকরা অর্থগ্রহণ করতে অস্বীকার করে কিন্তু হযরত ওসমান (রা.)-এর সময় তারা বিদ্রোহ শুরু করে ।


৬. কোরআন শরিফ দগ্ধীকরণ:

হযরত ওসমান (রা.)-এর শাসনকালে তার রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি পেলে দূরদূরান্তের অঞ্চলগুলোতে কোরআনের বিকৃত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় । এ অবস্থার সমাধানের জন্য হযরত ওসমান (রা.) জায়েদ বিন সাবিতের নেতৃত্বে একটি কোরআন সংকলন কমিটি গঠন করে । কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বিবি হাফসার নিকট রক্ষিত কোরআনের কপিটি সংরক্ষণ করে নির্ভুল ঘোষণা করেন এবং এর সাথে অসামঞ্জস্য রাষ্ট্রের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা বিকৃত কপিগুলো পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। হযরত ওসমান (রা.)- এর এরূপ মহৎ উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীরা তাঁর ওপর কোরআন পোড়ানোর অভিযোগ আনয়ন করেন ।


৭. ইবনে সাবার অপপ্রচার:

হযরত ওসমান (রা.)-এর শাসনকালে ইয়েমেনের জনৈক ইহুদি মাতার সন্তান ইবনে সাবা নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে হযরত ওসমান (রা.)-এর বিপক্ষে ও হযরত আলি (রা.)-এর পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। কুফা ও বসরায় তার মতবাদ প্রচার হলে মুসলিম উম্মাহ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়লে বিদ্রোহের পথ উন্মুক্ত হয়। 


৮. হযরত ওসমান (রা.)-এর পদত্যাগ দাবি ও হত্যাকাণ্ড:

হযরত ওসমান (রা.)-এর বিরুদ্ধে উপরিউক্ত মিথ্যা অভিযোগুলো উত্থাপনের ফলে সাম্রাজ্যে অরাজকতার সৃষ্টি হয়। বিদ্রোহীরা দলে দলে মদিনার দিকে ধাবিত হয়। তারা খলিফাকে শাসনকার্যের অনুপযুক্ত ঘোষণা করে তার পদত্যাগ দাবি করে। খলিফা তা প্রত্যাখ্যান করলে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে ১৭ জুন বিদ্রোহী 7 ঘাতক গোষ্ঠী সরলমনা বৃদ্ধ খলিফাকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করে। 


হযরত ওসমান (রা.)-এর হত্যার ফলাফল:  নিম্নে হযরত ওসমান (রা.) হত্যার ফলাফল আলোচনা করা হলো :


১.খিলাফতের পবিত্রতা নষ্ট:

হযরত ওসমান (রা.) হত্যার ফলে খলিফা ও খিলাফতের প্রতি জনসাধারণের শ্রদ্ধা কমে যায়। ফলে তাদের কাছে খিলাফতের পবিত্রতা নষ্ট হয়। খোদাবক্স বলেছেন, এটা সর্বকালের জন্য খলিফার ব্যক্তিগত পবিত্রতা নষ্ট করেছিল।


২. গণতন্ত্রের অবসান:

হযরত ওসমান (রা.) হত্যার মধ্য দিয়ে মুসলিম সাম্রাজ্যে যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিরাজ করছিল তার সমাপ্তি ঘটে ।


৩. রাজতন্ত্রের উদ্ভব:

হযরত ওসমান (রা.)-এর পতন ও মৃত্যুতে গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পতন ঘটে ও রাজতন্ত্রের উদ্ভব হয়। ঐতিহাসিক খোদাবক্সের ভাষায়, এটা ঈশ্বরতন্ত্রকে রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত করেছিল।


৪. গৃহযুদ্ধের সূচনা:

হযরত ওসমান (রা.)-এর হত্যার ফলে মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটে। জোসেফ হেলের মতে, ওসমানের হত্যা ছিল গৃহযুদ্ধের বিপদ সংকেতস্বরূপ।


৫. মুসলমানদের ঐক্যে ফাটল:

হযরত ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মুসলমানদের মাঝে যে ঐক্য সম্প্রীতি বিরাজমান ছিল তার ফাটল ঘটে। এর মাধ্যমে মুসলিম জাহান হাশেমি ও উমাইয়া দুই গোত্রে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।


৬. মক্কা মদিনার প্রাধান্য হ্রাস:

হযরত ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সারা বিশ্বের কাছে মুসলিম খিলাফতের কেন্দ্রস্থল মক্কা মদিনার প্রাধান্য ও মর্যাদা হ্রাস পায়।


৭. বিভিন্ন দলের উদ্ভব:

হযরত ওসমান (রা.)-এর মৃত্যুর ফলে মুসলমানদের মাঝে নানা দল, উপদল, সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। যেমন ইবনে সাবার নেতৃত্বে শিয়া মতবাদের উদ্ভব ঘটে ।


উপসংহার:

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, হযরত ওসমান (রা.)-এর সরলতা, সহজ সরল মনোভাব তাঁর হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কারণ। তাঁর সরলতাকে দুর্বলতা মনে করেই বিদ্রোহীরা নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য খলিফার বিরুদ্ধে বহুমুখী ষড়যন্ত্র পরিচালনা করে। যার ফলে ইসলামের তৃতীয়- খলিফা হযরত ওসমান (রা.)-কে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়। তাই বলা যায়, হযরত ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ড ছিল শত্রুর আশার বাস্তব প্রতিফলন ও ইতিহাসের রূপরেখা পরিবর্তনকারী অধ্যায় ।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post