মনোবিজ্ঞান কী? সমাজকর্মের সাথে মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক আলোচনা কর ।

মনোবিজ্ঞান কী? সমাজকর্মের সাথে মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক আলোচনা কর ।

   মনোবিজ্ঞান কী? সমাজকর্মের সাথে মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক আলোচনা কর ।

ভূমিকা :

মানুষের কৌতূহলকে কেন্দ্র করেই অন্যান্য বিজ্ঞানের মতো মনোবিজ্ঞানের উৎপত্তি। মনোবিজ্ঞান ব্যক্তির মানসিক প্রক্রিয়াসমূহের ব্যাখ্যা করে। বিশেষত ব্যক্তির আবেগ, অনুভূতি, জ্ঞান, হতাশা, একাকিত্ব প্রভৃতির ওপর আধুনিক মনোবিজ্ঞান বিশেষ চর্চা করে। তাই প্রায়োগিক দিক থেকে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে মনোবিজ্ঞানের সাথে সমাজকর্মের সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে বেশি।

মনোবিজ্ঞান :

মনোবিজ্ঞানের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Psychology’ যা দুটি গ্রিক শব্দ ‘Phyche’ ও ‘Logos’ থেকে এসেছে। এদের অর্থ যথাক্রমে আত্মা ও জ্ঞান। সুতরাং শাব্দিক অর্থে মনোবিজ্ঞান হলো আত্মা বা মন সম্পর্কিত বিজ্ঞান।সাধারণ অর্থে যে বিজ্ঞান মানুষ এবং প্রাণীর আচরণ নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা এবং বিশ্লেষণ করে তাকে মনোবিজ্ঞান বলে । অর্থাৎ মানুষ বা প্রাণীর আচরণ সম্বন্ধীয় বিজ্ঞানই মনোবিজ্ঞান।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা :

উডওয়ার্থের মতানুসারে, মনোবিজ্ঞান হলো পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তির ক্রিয়াকলাপসম্পৰ্কীয় বিজ্ঞান ।

মনোবিজ্ঞানী প্যাভলভের মতে, মনোবিজ্ঞান হচ্ছে দৃষ্টিগোচর আচরণের পর্যালোচনা।

প্লেটো ও এরিস্টেটলের মতে,  মনোবিজ্ঞান হলো আত্মাসম্পর্কীয় বিজ্ঞান ।

মরগান এর মতে,  মনোবিজ্ঞান হলো মানুষ ও প্রাণীর আচরণের বিজ্ঞান।

মনোবিজ্ঞানী ই, আর, হিলগার্ড বলেন, “মনোবিজ্ঞানকে এমন বিজ্ঞান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে, যা মানুষ প্রাণীর আচরণ সম্বন্ধে অনুধ্যান করে।” 

আর্থার গেইট বলেন, “মনোবিজ্ঞান জীবন্ত প্রাণীর আচরণের ব্যাখ্যায় সাধারণ সূত্র প্রণয়নের চেষ্টা করে, মানুষ, পশু ও অন্যান্য প্রাণী বিভিন্ন ধরনের যেসব কাজ করে এ বিজ্ঞান তা চিহ্নিত, বর্ণনা ও শ্রেণিবিন্যাস করতে প্রয়াস পায়।”

অতএব বলা যায় যে, মনোবিজ্ঞান হলো, এমন একটি বিজ্ঞান, যা জীবের আচরণ সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করে। অর্থাৎ মনোবিজ্ঞান মানুষ ও প্রাণীর আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়া সম্বন্ধে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে ।

সমাজকর্মের সাথে মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক :


মনোবিজ্ঞান কী? সমাজকর্মের সাথে মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক আলোচনা কর ।

সমাজকর্ম ও মনোবিজ্ঞান গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। নিম্নে এ দুইয়ের সম্পর্ক আলোচনা করা হলো-

১. বিষয়বস্তুগত দিক :

মনোবিজ্ঞান মানব আচরণ নিয়ে আলোচনা করে থাকে । আর সমাজকর্মও মানুষের আচরণ পর্যালোচনা করে মানুষের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে থাকে । সমাজের মানুষের উন্নয়ন, অগ্রগতি, প্রতিকূল পরিবেশ দূরীকরণ সমাজকর্মের অন্যতম লক্ষ্য । আর এজন্যই মনোবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম উভয়ই মানব আচরণের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে। 


২. সমস্যা নির্ণয় :


সমাজকর্মের প্রধান লক্ষ্য হলো ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যার সমাধান করে মানব সেবা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা। এজন্য সমাজকর্মীকে সমস্যার গভীরে গিয়ে এর কারণ, উৎস ও প্রকৃতি ইত্যাদি উদ্ঘাটন করতে হয়। এক্ষেত্রে সমাজকর্মীকে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়াবলি বিশ্লেষণ করতে হয়। মনোবিজ্ঞান মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা বিশ্লেষণের সবচয়ে বড় বিজ্ঞান।

মনোবিজ্ঞান কী? সমাজকর্মের সাথে মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক আলোচনা কর ।

৩. আচরণ বুঝতে সাহায্য করা :

সমাজকর্ম ব্যক্তির সমস্যা নিরূপণের জন্য ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, তার আবেগ, বুদ্ধি, হতাশা, বিষয়বস্তু মান প্রত্যক্ষণ করার ক্ষমতা জানতে হয় এবং ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির জন্য ভিন্ন ভিন্ন সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। একমাত্র মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানই সমাজকর্মীকে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, আবেগ, হতাশা প্রভৃতি বুঝতে সহায়তা করে।

৪. সুপ্ত ক্ষমতার বিকাশ :

সমাজকর্ম মানুষের সুপ্ত ক্ষমতার বিকাশ বৈ সাধনের মাধ্যমে সমাজের মানুষের কল্যাণসাধন করতে চায়। এদিকে মনোবিজ্ঞান মানুষের সুপ্ত ক্ষমতার বিকাশের উপায় নির্দেশ করে তা কাজে লাগায় ।

৫. উভয়ই সামাজিক বিজ্ঞান :

সামাজিক বিজ্ঞানের অতি গুরুত্বপূর্ণ দুটি শাখা হচ্ছে সমাজকর্ম ও মনোবিজ্ঞান। সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বিজ্ঞানের কারণে উভয়েরই একে অপরের মধ্যে মিল রয়েছে। এজন্য একে অপরের সহায়তা করার সুযোগও রয়েছে। এর ফলে উভয়ের জ্ঞান পারস্পরিক কাজে আসে।

৬. জ্ঞানগত সম্পর্ক :

সমাজকর্মের অন্যতম লক্ষ্য হলো ব্যক্তিকে সমাজ উপযোগী আচরণ করতে সক্ষম করে তোলা। এক্ষেত্রেও মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান সমাজকর্মীদের বিশেষভাবে সাহায্য করে। বিশেষ করে মনোবিজ্ঞানের ব্যক্তিত্ববিষয়ক তত্ত্বের জ্ঞান সমাজকর্মীদেরকে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের দুর্বলতা খুঁজে দি বের করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে সাহায্য করে।

৭. লক্ষ্যকেন্দ্রিক সম্পর্ক :

সমাজকর্ম ও মনোবিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য হলো মানুষকে তার সমস্যার সমাধান ঘটিয়ে একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক জ্ঞানের প্রতি প্রত্যাশিত করে তোলা।  তবে লক্ষ্য পূরণে দুইভাবে কাজ করে থাকে ।

৮. ব্যক্তি ও পরিবেশের উন্নয়নে :

সমাজকর্ম ব্যক্তি ও পরিবেশের উন্নয়ন চায় । ব্যক্তির সমস্যা সমাধান ও অনুকূল পরিবেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজকর্ম সুন্দর পৃথিবী গড়তে চায়। সুন্দর পৃথিবী গড়তে ব্যক্তি ও পরিবেশ সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জনের জন্য মনোবিজ্ঞানের সহায়তা নিতে হয়।

৯. অংশগ্রহণ ও উদ্বুদ্ধকরণ :

সমাজকর্মের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হয়। আর মনোবিজ্ঞান মানসিক প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠুভাবে সচল রাখতে সর্বাত্মক সহায়তা করে থাকে । সুতরাং এদিক থেকে উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক বিদ্যমান।

১০. মনোচিকিৎসার ক্ষেত্রে :

সমাজকর্ম অস্বাভাবিক ও বেকারদের চিকিৎসা ও উন্নয়নের জন্য মনোবিজ্ঞানের বিশেষ শাখার অস্বাভাবিক মনোবিজ্ঞান থেকে জ্ঞান অর্জন করে থাকে।

১১. অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে :

অপরাধ শনাক্ত করার জন্য বিভিন্ন কৌশল ও যন্ত্র আবিষ্কার করেছে মনোবিজ্ঞান। তাই মনোবিজ্ঞান ব্যবহার করে কিশোর অপরাধসহ সামাজিক অপরাধসমূহ দূর করতে সমাজকর্মকে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হয় ।

উপসংহার :

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সমাজকর্মের তাত্ত্বিক ভিত্তি অর্জনে এবং ব্যবহারিক অনুশীলনে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলেও দুটি বিজ্ঞানের মধ্যে বেশকিছু পার্থক্য বিদ্যমান। তবে মানব আচরণ বিশ্লেষণ করে মানবিক সার্বিক কল্যাণ ও উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে সমাজকর্মকে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানের ওপর নির্ভর করতে হয় । 


Post a Comment

Previous Post Next Post