সামাজিক নিরাপত্তা বলতে কী বুঝ? বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত সামাজিক আইনসমূহ আলোচনা কর।
ভূমিকা :
সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবমূল্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত সমাজকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ধারণা হলো সামাজিক নিরাপত্তা। শিল্পবিপ্লবের পর রাষ্ট্রের ভূমিকায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়। বিশেষ করে আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্র তার নাগরিকদের ন্যূনতম জীবনমান বজায় রাখতে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি এ ধরনের কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম।
সামাজিক নিরাপত্তা :
সামাজিক নিরাপত্তা এক ধরনের সামাজিক প্রতিরক্ষামূলক কর্মসূচি, যাতে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থায় বা বিপদকালীন সময়ে মানুষকে অর্থনৈতিক সহায়তা করা হয়। ব্যাপকভাবে বলা যায়, মানুষের জীবনে এমন কিছু বিপদ আসে যেগুলো সে তার সম্পদ ও সামর্থ্য দিয়ে মোকাবিলা করতে পারে না, এ ধরনের বিপদের সময় রাষ্ট্র কর্তৃক বিপদ মোকাবিলার জন্য যে সামাজিক প্রতিরক্ষামূলক কর্মসূচি পরিচালিত হয় তাকে সামাজিক নিরাপত্তা বলে ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা :
সামাজিক নিরাপত্তার রূপকার উইলিয়াম বিভারিজ এর মতে, “বেকারত্ব অসুস্থতা বা দুর্ঘটনা, বৃদ্ধ বয়সে চাকরি হতে অবসর গ্রহণ, পরিবারের উপার্জনশীল ব্যক্তির মৃত্যু এবং মৃত্যু ও বিয়ের সময় অতিরিক্ত ও অস্বাভাবিক ব্যয়ের কারণে যখন কোনো পরিবারের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়, তখন যে কর্মসূচির মাধ্যমে আয়ের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয় তাকে সামাজিক নিরাপত্তা বলে ।”
ডি. পল. চৌধুরী এর মতে, সামাজিক নিরাপত্তা সাধারণ সমাজকল্যাণের একটি বিষয় অথবা এটি সাধারণ মঙ্গল আইনের একটি পদ্ধতি ।
Social Work Dictionary গ্রন্থে বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা সমাজের বা রাষ্ট্রের নাগরিকদের আয় সহায়তা দেওয়ার এক ধরনের বিধান । যাদের আয় আইনগতভাবে সংজ্ঞায়িত দুর্ঘটনা বা বিপদ যেমন— বৃদ্ধ, অসুস্থ, তরুণ অথবা বেকার হওয়ার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে।
অতএব বলা যায় যে, সামাজিক নিরাপত্তা মূলত প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক কর্মসূচির সমষ্টি যা নাগরিকদের অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম করে তুলতে সহায়তা করে। সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানব মূল্যের ওপর ভিত্তি করে সমাজকর্মের সাথে সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা সামাজিক নিরাপত্তা। এটি প্রত্যেক নাগরিক ও পরিবারের ন্যূনতম জীবনমান বজায় রাখতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তাসংক্রান্ত সামাজিক আইনসমূহ :
বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তাসংক্রান্ত সামাজিক আইনসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১. সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ আইন ১৮২৯ :
সামাজিক নিরাপত্তাসংক্রান্ত আইনসমূহের মধ্যে সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ আইনটি একটি যুগান্তকারী আইন। ব্রিটিশ শাসনামলে রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮২৯ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ আইন প্রবর্তন করেন। এর ফলে বিধবা হিন্দু নারীরা নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। এ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে মৃত স্বামীর সাথে জীবিত স্ত্রীর চিতায় আত্মহুতির ন্যায় জঘন্য অমানবিক প্রথা বিলুপ্ত হয়।
২. হিন্দু বিধবাবিবাহ আইন, ১৮৫৬ :
হিন্দু বিধবাদের পূনর্বাসনের লক্ষ্যে হিন্দু বিধবাবিবাহ আইন প্রবর্তন করা হয়। স্বামীহারা স্ত্রীদের সমাজে করুণভাবে বেঁচে থাকার যে যন্ত্রণা তা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেস্টায় ১৮৫৬ সালে বিধবাবিবাহ আইন প্রণীত হয়। এর ফলে হিন্দু বিধবারা নতুন করে বিয়ের মাধ্যমে স্বামী সংসার নিয়ে স্বাভাবিক জীবন লাভের সুযোগ লাভ করে ।
৩. শ্রমিক ক্ষতিপূরণ আইন ১৯২৩ :
শ্রমিকদের পেশাগত দুর্ঘটনা, সামাজিক নিরাপত্তা ও নিরাপত্তা ও রোগাক্রান্তদের আর্থিক ক্ষতিপূরণের লক্ষ্যে আইনটি প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের ফলে কলকারখানা, বন্দর, চা বাগান, রেলওয়েতে যারা কাজ করে তাদের কেউ কর্মস্থলে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কর্মক্ষমতা হারালে বা অসুস্থ হলে অথবা ঘটনাস্থলে মারা গেলে মালিক পক্ষকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদানে বাধ্য করা হয়।
৪. বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯ :
নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের লক্ষ্যে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয়। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধকল্পে এ আইনের বিধান অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়ে এবং ২১ বছরের কম বয়সি ছেলের বিবাহ আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত। এ আইনের ফলে অল্পবয়সে বিবাহ, পারিবারিক ভাঙন, বৈধব্য, অসম্পূর্ণ মাতৃত্ব ও পিতৃত্ব, অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি সমস্যা মোকাবিলার পথ সুগম হয়।
৫. মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ :
মুসলিম পরিবারে নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান তাদের স্বার্থরক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করার একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ হচ্ছে এ আইন। এ আইন নারী ও শিশুর স্বার্থরক্ষায় এবং পারিবারিক ভাঙন রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মাধ্যমে পিতা মারা গেলে দাদার সম্পত্তির ওপর শিশু সন্তানের অধিকার স্বীকৃত হয়। এ ছাড়া স্ত্রীর ভরণপোষণের ক্ষেত্রে স্বামীর দায়িত্ব সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট, বিধিবিধান প্রণীত হয়। এছাড়াও ভারতীয় কারখানা আইন ১৯৩৪, শিশু শ্রমিক নিয়োগ আইন ১৯৩৮, ভবঘুরে আইন ১৯৪৩ ইত্যাদি সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানে বিশেষ অবদান রাখে।
৬. শিশু আইন ১৯৭৪ :
শিশুর ভবিষ্যৎ সুন্দরভাবে গঠনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি, তাদের সুরক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং শিশু-কিশোরদের অপরাধের বিচারের জন্য ১৯৭৪ সালে আইনটি প্রণীত হয়। এ আইনের ভিত্তিতে ১৯৭৬ সালে আরেকটি শিশু আইন প্রবর্তন করা হয়। এর ফলে জাতীয় কিশোর সংশোধনী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশে এ আইনটি সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখছে।
৭. যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০ :
দুর্বল, অবহেলিত ও নির্যাতিত নারী সমাজের অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের লক্ষ্যে যৌতুক নিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয়। বিয়ের সময় কনেপক্ষের কাছে বরপক্ষ যে যৌতুক দাবি করে তাতে কন্যার পরিবারসহ নবদম্পতির জীবনে নেমে আসে এক চরম দুর্গতি ও বিশৃঙ্খলা। এরূপ যৌতুক প্রথা বিলুপ্ত করে সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত করতে ১৯৮০ সালে যৌতুক নিরোধ আইন প্রণীত হয়। এর ফলে যৌতুক দাবিকারীর জন্য শান্তিমূলক বিধান প্রণীত হয় যাতে এদেশের নারীসমাজসহ কন্যা দায়গ্রস্ত অভিভাবকগণ স্থিতিশীল পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশের নিশ্চয়তাসহ কন্যাকে বিবাহ দিতে সক্ষমতা লাভ করে।
৮. নারী নির্যাতন অধ্যাদেশ ১৯৮৩ :
যৌতুকের জন্য অত্যাচার, অবৈধ যৌন কাজে ব্যবহার, জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়া, চ পতিতাবৃত্তিতে নিয়োগ, অপহরণ ও পাচার রোধে প্রভৃতি নারী নির্যাতন প্রতিরোধে এ আইনটি প্রবর্তন করা হয়। নারী ও শিশু সমাজের সামাজিক মর্যাদা সমুন্নত রাখতে এ আইনটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। এদেশের সচেতন জনগোষ্ঠী বিগত দুই দশক যাবৎ আইনটির সুফল ভোগ করছে।
৯. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০:
মুক্তিপণ আদায়ে শিশু অপহরণ, অবৈধভাবে নারী ও শিশু পাচার, সীমাহীন
নির্যাতন ইত্যাদি থেকে নারী ও শিশুদের রক্ষার্থে ১৯৮০ সালের পর থেকে ২০০০ সালের
পূর্ব পর্যন্ত প্রণীত কতিপয় আইনের কার্যকারিতা ও বাস্তবে প্রয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে
২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণীত হয় । এ আইনের আলোকে এদেশে নারী ও
শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে। এছাড়াও বাংলাদেশ
পরিত্যক্ত, শিশু আদেশ ১৯৭২, মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন ১৯৭৪, নারী ও
শিশু নির্যাতন আইন ১৯৯৫ বাংলাদেশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে আসছে।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তাসংক্রান্ত আইনসমূহ জনগণের বৃহত্তর কল্যাণে, বিশেষ গোষ্ঠী বা শ্রেণির স্বার্থরক্ষায় অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করছে, সামাজিক আইনসমূহের যথাযথ ব্যবহার এবং কার্যকর করার মাধ্যমে আমাদের সমাজে প্রকৃত শান্তি ও শৃঙ্খলা আনয়ন সম্ভব। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সব উদ্যোক্তা ও সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে যাতে জনগণকে আইনগুলোর সুফল ভোগে সক্ষম করে তোলা যায়।
You May also like: সামাজিক প্রতিষ্ঠান বলতে কী বুঝ?
সামাজিক আইনের উদ্দেশ্যসমূহ ও সামাজিক আইনের গুরুত্ব আলোচনা কর:
প্রাচীন সমাজব্যবস্থায় এমন কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান ছিল না, যা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। মানুষ নিজেদের প্রয়োজনেই যেদিন থেকে সংগঠিত হয়েছে সেদিন থেকেই নিজেদের স্বার্থে কিছু বিধিবিধান মেনে চলতে হয়েছে। একত্রে বসবাসের ক্ষেত্রে যাতে পারস্পরিক কোনো সমস্যা বা অসুবিধার সৃষ্টি না হয় সে কারণেই এসব বিধিনিষেধ মেনে চলা। এসব বিধিনিষেধের সামগ্রিক রূপই হচ্ছে সামাজিক আইন।
সামাজিক আইনের উদ্দেশ্যসমূহ : নিম্নে সামাজিক আইনের উদ্দেশ্যসমূহ উল্লেখ করা হলো—
১. সামাজিক ঐক্য ও ভারসাম্য রক্ষা :
সামাজিক উন্নয়ন সাধন ও সুখসমৃদ্ধি নিশ্চিতকরণের স্বার্থে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা ও ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যাবশ্যক। ঐক্য বিনষ্টকারী বিভিন্ন শক্তির কুপ্রভাবকে মানুষ সহজে প্রতিহত করতে পারে না। তাই এসব কুপ্রভাবকে প্রতিহত করতে সামাজিক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সামাজিক ঐক্য বা সংহতি আনয়ন ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা দূর করে সামগ্রিক ভারসাম্য রক্ষা করা হয়।
২. পরিকল্পিত সামাজিক পরিবর্তন সাধন :
সমাজজীবনে সৃষ্ট অবাঞ্ছিত অবস্থা দূরীকরণ ও সুশৃঙ্খলভাবে সামাজিক জীবনের সার্বিক উন্নয়নের জন্য দরকার পরিকল্পিত পরিবর্তন। পরিকল্পিত উপায়ে কোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে গেলে বিভিন্ন প্রতিবন্ধতার মুখোমুখি হতে হয়। সামাজিক আইন সেসব অবাঞ্ছিত অবস্থা প্রতিরোধ করে উন্নততর জীবনযাপনের সুযোগ নিশ্চিত করে।
৩. উন্নয়নের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি :
সামাজিক আইন সমাজের অনগ্রসরতা কাটিয়ে ও সামাজিক উন্নয়ন দ্রুততর করার প্রয়োজনে উন্নয়ন প্রতিবন্ধক বিভিন্ন অবস্থা, যেমন— কুসংস্কার, রক্ষণশীলতা, নিরক্ষরতা, অজ্ঞতা প্রভৃতি দূর করে থাকে। পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থায় মানুষ সহজেই খারাপ দিকগুলো চিহ্নিত করতে পারে।
৪. ভবিষ্যৎ সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা :
আকস্মিক দুর্ঘটনা ও বিপর্যয় মোকাবিলায় সামাজিক আইন মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চয়তা প্রদান করে থাকে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বিপর্যয়কালীন সামাজিক আইনগুলো কার্যকর করতে সচেষ্ট থাকে।
৫. আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ :
সমাজকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলার জন্য মানুষকে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সূত্রে আবদ্ধ থাকতে হয়। তাই সামাজিক সুখশান্তি ও অগ্রগতির স্বার্থে মানবীয় আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। সামাজিক আইন এক্ষেত্রে মানবীয় আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের জন্য সুস্থ ও সুন্দর জীবন লাভের ব্যবস্থা করে।
৬. অবহেলিত ও অনগ্রসর শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণ :
সামাজিক আইন সমাজে শোষিত, বঞ্চিত ও অবহেলিত নারী, শিশু, পঙ্গু, অসহায়, দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে। সামাজিক আইন সবার জন্য সমান সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। শোষিত, বঞ্চিত ও অবহেলিত গোষ্ঠী যাতে সমাজের অন্যদের মতো সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন লাভে সক্ষম হয় সামাজিক আইনের দ্বারা সে প্রচেষ্টাই চালানো হয়।
৭. সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা :
সামাজিক আইন সমাজের সব শ্রেণি মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের প্রতি সমান গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। এক্ষেত্রে আইনকানুনের কঠোরতা সৃষ্টি করে সামাজিক বৈষম্য দূর করার চেষ্টা করা হয়। সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং তা সঠিক সংরক্ষণের রক্ষাকবচ হিসেবে সামাজিক আইন কাজ করে।
৮. সুসম বণ্টন নিশ্চিতকরণ :
সম্পদ ও সুযোগ সুবিধার অসম বণ্টন সমাজে অস্থিরত ও অনাচার সৃষ্টি করে থাকে। ফলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নতি ব্যাহত হয়। সমাজের সম্পদ ও সুযোগ সুবিধা যাতে বিশেষ শ্রেণির হাতে কুক্ষিগত না হয়, তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে সামাজিক আইন প্রণীয় হয় ।
৯. সচেতনতা সৃষ্টি :
সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করার জন্য প্রত্যেককে তার অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়। সামাজিক আইনের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের মানুষকে অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলা, যাতে প্রতিটি মানুষ আইনগত কাঠামোর অধীনে নিজ নিজ অধিকার ভোগের মাধ্যমে অন্যের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে ।
১০. বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সমস্যা সমাধান :
প্রতিটি সমাজেই কোনো না কোনো সমস্যা থাকে এবং প্রতিটি মানুষই
সমস্যামুক্ত সুন্দর সমাজে বসবাস করতে চায়। তাই বর্তমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে
সামাজিক আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সেগুলোর প্রতিকারের মাধ্যমে সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা
সম্ভব। ভবিষ্যতেও যাতে সে সমস্যাগুলো মাথা চাড়া দিতে না পারে সে ব্যাপারে সামাজিক
আইন সহায়তা করে ।
You
May also like: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায়সমূহ আলোচনা কর।
সামাজিক আইনের গুরুত্ব : নিম্নে সামাজিক আইনের গুরুত্ব/ প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হলো-
১. সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা :
সামাজিক আইন সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখে এবং উন্নয়ন কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করে। আর সামাজিক সুখশান্তি ও অগ্রগতির স্বার্থে মানবীয় আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। সামাজিক আইন এক্ষেত্রে নাগরিকদের শাস্তিদান বা ভয় দেখিয়ে মানবীয় আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের জন্য সুস্থ ও সুন্দর জীবন লাভের ব্যবস্থা করে।
২. সমাজের বাঞ্ছিত পরিবর্তন :
সামাজিক আইন সর্বদা সমাজকে প্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সমাজের মানুষ যাতে ভালোভাবে বসবাস করতে পারে এজন্য সামাজিক পরিবেশ উন্নয়নে সামাজিক আইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সামাজিক আইন সমাজের বাঞ্ছিত পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে সমাজে কল্যাণ বয়ে আনে। এর ফলে সমাজে কেউ কাউকে শোষণ করতে পারে না এবং কেউ ইচ্ছা করলেই আইনবিরোধী কোনো কার্যক্রম করাতে পারে না। সুতরাং সমাজের বাঞ্ছিত পরিবর্তনে সামাজিক আইনের গুরুত্ব অত্যধিক।
৩. সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা :
সামাজিক আইন সামজের সব শ্রেণি মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের প্রতি সমান গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। এক্ষেত্রে আইনকানুনের কঠোরতা সৃষ্টি করে সামাজিক বৈষম্য দূর করার চেষ্টা করা হয়। সামাজিক সাম্য, ন্যায়বিচার মানুষের মধ্যে সুসম বণ্টন নিশ্চিত করে সামাজিক সমতা ও ন্যায়বোধ সৃষ্টি করে ।
৪. সামাজিক সামঞ্জস্যবিধান :
সামাজিক আইন সমাজের স্থিতিশীলতার পরিচায়ক। তাই পরিবর্তিত ও প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থার সাথে মানুষ যাতে একাত্ম হতে পারে সে ব্যাপারে সামাজিক আইন যথেষ্ট সহায়তা করে। সমাজে সবাই মিলে যাতে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে সামাজিক আইন তার নিশ্চয়তা বিধান করে। সুতরাং সামাজিক আইন সমাজের সব শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণের প্রচেষ্টা চালায় এবং সমাজের সব মানুষের জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করে।
৫. সম্পদের সুসম বণ্টন :
সম্পদের বণ্টন সুসম না হলে সমাজে শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টি হতে পারে। ফলে সামাজিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হতে পারে। সামাজিক আইন প্রয়োগ করে সম্পদের সুসম বণ্টনের ভিত্তিতে শ্রেণিবৈষম্য দূরীকরণ সম্ভব।
৬. মাতৃত্বকালীন সুবিধা প্রদান :
শিল্পকারখানা, চাবাগান এবং সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মহিলাদের মাতৃত্বকালীন নিরাপত্তায় সামাজিক আইনের ভূমিকা অগ্রগণ্য। মাতৃত্ব কল্যাণ আইনের আওতায় মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং পূর্ণ বেতনসহ আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করা হয়।
৭. ঝুঁকি মোকাবিলা :
প্রায়ই দেখা যায় যে দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজজীবনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে মানুষকে নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি গ্রহণ করতে হয়। সামাজিক আইনের মাধ্যমেই সমাজজীবনে প্রচলিত বিভিন্ন নিশ্চয়তামূলক ‘ও নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির দ্বারা ঝুঁকি মোকাবিলায় সেবা প্রদান করা হয়। যেমন— আকস্মিক কর্মহীনতার ঝুঁকি, যুদ্ধকালীন অসুস্থতার ঝুঁকি। এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় সামাজিক আইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
৮. শ্রমিকদের নিরাপত্তা প্রদান :
পেশাগত কাজে নিয়োজিত থাকাকালীন কোনো শ্রমিক দুর্ঘটনায় মারা গেলে বা পঙ্গুত্ব বরণ করলে অথবা রোগাক্রান্ত হয়ে কর্মক্ষমতা হারালে ঐ শ্রমিককে অথবা তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক আইনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন— ১৯২৩ সালের শ্রমিক ক্ষতিপূরণ আইন দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক বা তার পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
৯. বিমা সুবিধা প্রদান :
অনেক মানুষ বিভিন্ন শিল্পকারখানা বা সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে জীবিকানির্বাহ করে। এসব মানুষ যতদিন কর্মক্ষম থাকে ততদিনই কাজের মাধ্যমে জীবনধারণ করতে সক্ষম, কিন্তু যখন বৃদ্ধ হয়ে পড়ে অথবা কর্মস্থল থেকে বিদায় নেয় তখন তাদের নিরাপত্তার অভাব দেখা দেয়। তাই বাংলাদেশে ১৯৬৯ সালে প্রণীত হয়। এর দ্বারাই সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের যৌথ বিমার আওতাভুক্ত করা হয়েছে। ফলে চাকরিকালীন কোনো কর্মচারীর মৃত্যু হলে তার পরিবার যৌথ বিমার অধীনে আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকে।
১০. নির্ভরশীল নিরাপত্তা প্রদান :
সামাজিক আইনের মাধ্যমে নির্ভরশীল শিশু ও বৃদ্ধ লোকজন যারা পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের চাহিদা পূরণ ও সমস্যা মোকাবিলায় পরিপূর্ণ সহায়তা পাচ্ছে না, তাদের কল্যাণে বিশেষ বিশেষ কর্মসূচি গৃহীত হয়ে থাকে। এছাড়া আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্রে সক্ষম বেকারদের জন্যও ভাতার ব্যবস্থা করা যাচ্ছে। বাংলাদেশে বয়স্ক ভাতা, যুবকল্যাণ কর্মসূচি এবং ছোটোমনি নিবাসগুলো সামাজিক আইনের অধীনেই কাজ করে যাচ্ছে।
You
May also like: পরিবারের উৎপত্তি সংক্রান্ত মর্গানের তত্ত্বটির বর্ণনা কর।
উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায় যে, সামাজিক বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ কিংবা প্রতিরোধকল্পেই
বিভিন্ন আইনের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে। সামাজিক
নিরাপত্তাহীনতার প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের লক্ষ্যেই সামাজিক আইনের প্রয়োজন হয়।
যুগ যুগ ধরে সমাজে অবহেলিত ও নিপীড়িত মানুষের নিরাপত্তায় যেসব অসংগঠিত সাহায্য
সহায়তা কর্মসূচি চালু হয়েছে সেগুলো সংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানে সামাজিক আইন
কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে ।