ভূমিকা :
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ুর কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ দেশের একটি পরিচিত দৃশ্যপট। তীব্রতা ও ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতায় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। প্রায় প্রতি বছরই এ দেশে কোনো না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয় । এর ফলে জনগণ চরম দুর্ভোগ পোহায়, ব্যক্তি ও পরিবারের সম্পদ বিনষ্ট হয়, বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস হয়, দেশ ও জাতির উন্নয়নের ধারা বিঘ্নিত হয় এবং পরিবেশের দ্রুত অবনতি ঘটে। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও সময়মতো পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে এবং বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, কলা-কৌশল ও জনগণের সচেতনতা সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে লাঘব করা সম্ভব। এজন্য সরকারসহ দেশের প্রতিটি নাগরিককে দুর্যোগ মোকাবিলায় সচেতন ও সচেষ্ট হতে হবে ।
দুর্যোগ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ কি
প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট যে সকল ঘটনা মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারাকে ব্যাহত করে, মানুষের সম্পদ ও পরিবেশের এমনভাবে ক্ষতিসাধন করে যার ফলে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যতিক্রমধর্মী প্রচেষ্টার মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হয়, তা-ই হলো দুর্যোগ। আর প্রাকৃতিক কারণে যে সকল দুর্যোগ সংঘটিত হয় সেগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা :
বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর অন্যতম । প্রায় প্রতি বছরই বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয় বাংলাদেশ। এ দেশের প্রধান প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, বন্যা, খরা, নদীভাঙন, ভূমিকম্প, আর্সেনিক দূষণ ইত্যাদি বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের রূপ অত্যন্ত ভয়াবহ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনে। এক হিসাবে দেখা যায়, বিগত ১৩১ বছরে এ অঞ্চলে সংঘটিত বড় বড় ১০টি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে 'সিডর'-এর মাত্রা ছিল ভয়ঙ্কর ।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘটে যাওয়া এ ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২.৩ মিলিয়ন ডলার, নিহতের সংখ্যা দশ সহস্রাধিক এবং উপকূলীয় প্রায় ২২টি জেলায় এর প্রভাব পড়েছিল। ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি থেকে ১৯৯৭ সালের জুন পর্যন্ত এ দেশে ছোট ও বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাস ও কালবৈশাখীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬৭টি এবং এর মধ্যে ১৫টি ছিল ভয়াবহ।
এ সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ৬ থেকে ৮ লক্ষ এবং প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে । এছাড়া পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিস্তা ইত্যাদি নদীতে ভাঙনের ফলে দেশের হাজার হাজার লোক গৃহহীন হয়ে পড়েছে। এ সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে অনেকাংশে পিছিয়ে দিয়েছে ।
নিম্নে বাংলাদেশের প্রধান প্রধানপ্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
বন্যা
নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রধান প্রাকৃতিক
দুর্যোগ বন্যা। ভৌগোলিক অবস্থান, ভূতাত্ত্বিক কাঠামো, অতি বৃষ্টিপাত, একই সময়ে প্রধান
নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি, নদীতে পলল সঞ্চয়ন, পানি নিষ্কাশনে বাধা, ভূমিকম্প, নির্বিচারে
বৃক্ষনিধন ইত্যাদি কারণে প্রায় প্রতি বছরই এ দেশে বন্যা হয়ে থাকে। বিগত দশকসমূহের
মধ্যে ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬৮, ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালে এ দেশে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে।
বর্তমানে এ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হিসেবে বন্যা আবির্ভূত
হয়েছে।
বন্যার ক্ষতি :
বন্যাজনিত ক্ষয়ক্ষতি এত ব্যাপক যে, স্বল্প পরিসরে তা আলোচনা করা কঠিন। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় জমির ফসলের। বন্যায় হাজার হাজার কোটি টাকার ফসলহানি ঘটে। গাছপালা ও ঘরবাড়ি বিনষ্ট হয়। রাস্তাঘাট ও সেতু ধ্বংস হয়। শহর-বন্দর ডুবে যাওয়ায় ব্যবসা- বাণিজ্যের বিপুল ক্ষতি হয়। বন্যার সময় মহামারীসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। বন্যার পানিতে পরিবেশ দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করে। এক কথায়, বন্যা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও উন্নয়নের ধারাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে।
খরা
সাধারণত বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে খরা পরিস্থিতি ঘটে থাকে। খরার প্রভাবে খরাপীড়িত এলাকার শস্যাদি পানির অভাবে শুষ্ক হয়ে লাল বর্ণ ধারণ করে এবং গাছপালা শুকিয়ে যেতে থাকে। মাঠের ফসলের জমিতে ফাটল দেখা দেয়। মাটির রস শুকিয়ে যায় এবং ভূগর্ভস্থ পানির লেভেল নিচে নামতে থাকে। নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-হাওর ইত্যাদিতে অন্যান্য বছরের তুলনায় খরার সময় পানি অস্বাভাবিকভাবে কমে যায় অথবা সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায় ।
বাংলাদেশে খরার কারণ :
বাংলাদেশে নিম্নবর্ণিত বিষয়সমূহ খরার
প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত । যথা :
ক. বাংলাদেশের পরিবেশগত ভারসাম্যের অবনতি
।
খ. মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ।
গ. নির্বিচারে বন উজাড় ।
ঘ. ভৌগোলিক আবহাওয়ার পরিবর্তন।
ঙ. পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ।
চ. ভারত কর্তৃক যৌথ নদী (৫৪) থেকে একতরফাভাবে
পানি প্রত্যাহার। এতে ভূ-উপরিস্থ পানির প্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে, ফলে বাষ্পীকরণের পরিমাণ
কমছে ।
ছ. অপরিকল্পিত ও মাত্রাতিরিক্ত জমি চাষাবাদ।
এতে মাটিতে পানি প্রাপ্যতা দিন দিন কমছে এবং প্রাকৃতিক নিয়মে বাষ্পীকরণের পরিমাণ হ্রাস
পাচ্ছে।
জ. সময়োপযোগী সুষম বৃষ্টির অভাব ইত্যাদি
।
বাংলাদেশের বর্তমান খরা পরিস্থিতি :
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক কারণে পানির চাহিদা অত্যন্ত প্রকট হওয়া সত্ত্বেও শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টিপাত কম হয় । আবার গ্রীষ্ম-বর্ষাকালে আশানুরূপ বৃষ্টিপাত না হলে সেচ, কৃষি, ফসল উৎপাদনসহ বিভিন্ন পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিদারুণ সংকটসহ দেশে খাদ্যঘাটতি দেখা দেয়। সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশে যখনই খরা হয় তখন কম বৃষ্টিপাতের কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণ ফসল উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটে; ভূগর্ভস্থ পানি পুনর্ভরণ হ্রাস পায়; খাল-বিল-পুকুর ইত্যাদিতে পূর্বের চেয়ে কম পানি থাকে। এমনকি ভূ-উপরিস্থ অধিকাংশ জলাশয় শুকিয়ে যায় এবং গৃহস্থালী কাজে পানির সংকট দেখা দেয়, উষ্ণ আবহাওয়া বিরাজ করে এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় । এক কথায়, খরা বাংলাদেশের জনজীবনে ব্যাপক দুর্ভোগ ডেকে আনে ।
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস এ বাংলাদেশের জীবন, সম্পদ ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয় । নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ-
ঘূর্ণিঝড় :
সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড় কথাটি এসেছে গ্রীক ‘কাইক্লোস' শব্দ থেকে । এর অর্থ সাপের কুণ্ডলী। বিজ্ঞানের বিশ্লেষণ মতে, সাইক্লোন হচ্ছে নিম্নচাপ উদ্ভূত একটি এলাকা। কোনো অল্প পরিসর স্থানে হঠাৎ বায়ুর উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে বায়ু হালকা হয়ে ওপরে উঠে এবং সেখানে নিম্নচাপ কেন্দ্রের সৃষ্টি হয়। তখন চারদিকের শীতল ও ভারী বায়ু প্রবল বেগে ঐ নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে ছুটে আসে এবং ঘুরতে ঘুরতে কেন্দ্রে প্রবেশ করে । এই কেন্দ্রমুখী প্রবল বায়ুপ্রবাহকেই ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোন বলে ।
জলোচ্ছ্বাস :
ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রে বা চক্ষুতে বাতাসের চাপ খুব কম থাকায় কেন্দ্রের কাছাকাছি অঞ্চলে সমুদ্রের পানি ফুলে ওঠে। একেই জলোচ্ছ্বাস বলে। কোনো দ্বীপাঞ্চল বা উপকূল দিয়ে ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাওয়ার সময় ঝড়ের ঢেউ ও ঝড়ের জোয়ার এসে প্লাবন ঘটায়। তারপর ঝড়ের চক্ষু যদি সে স্থান দিয়ে অতিক্রম করে তবে ঝড়ের ঢেউ, ঝড়ের জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস এই তিনটির সমন্বয়ে ঐ স্থানের বিরাট অংশ ডুবে যায় । অমাবস্যা বা পূর্ণিমার ভরা কাটালের সময় যদি জলোচ্ছ্বাস হয়, তবে তার ফল আরো মারাত্মক হয়।
বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় :
বাংলাদেশ মৌসুমী বায়ুর দেশ। এখানে মৌসুমী ঘূর্ণিঝড় বেশি হয়। সাধারণত বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে ইংরেজি এপ্রিল-মে মাসে, বর্ষা মৌসুমের শেষে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর বঙ্গোপসাগরে গড়ে ১৩-১৪টি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে ৪-৫টি ঘূর্ণিঝড়ের যে কোনোটির বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানার সম্ভাবনা থাকে ।
বাংলাদেশের যে সকল এলাকায় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে :
বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস বেশি আঘাত হানে। এই উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো হচ্ছে বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ।
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ক্ষতি :
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশে নিয়মিত আঘাত হানে এবং এর কোনো কোনোটি খুবই মারাত্মক হয়। ১৯৬০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০টি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে। এতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ও পশুপাখি নিহত হয়েছে। কোটি কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে। প্রাকৃতিক বন সুন্দরবন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রচুর বৃক্ষসম্পদ ধ্বংস হয়, বন্যপ্রাণী ও গবাদিপশু মারা যায়, ব্যাপক আবাদি জমিতে লোনাপানি ঢুকে পড়ে, ফলে বিপুল পরিমাণ ফসল ধ্বংস হয়। মানুষের ঘরবাড়ি ও অন্যান্য অবকাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক কথায় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারায় অপরিসীম ক্ষতিসাধন করে ।
কালবৈশাখী
কালবৈশাখী বাংলাদেশের আরেকটি নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কালবৈশাখী প্রতি বছরই এ দেশে আঘাত হানে। সাধারণত চৈত্র-বৈশাখ মাসে কালবৈশাখীর প্রচণ্ড থাবা শুরু হয়।
এ সময় হঠাৎ দেখা যায় দুপুরের পর আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে যায় এবং উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রচণ্ড বেগে ঝড় বইতে থাকে। এর সঙ্গে শুরু হয়ে যায় বজ্র বিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাত, কখনো বা শিলাবৃষ্টি। কালবৈশাখীতে বনজসম্পদ, ঘরবাড়ি, গবাদিপশু, ফসল, জীবন ও অন্যান্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয় ।
নদীভাঙন
সীমিত ভৌগোলিক আয়তনের এই বাংলাদেশে নদীভাঙন একটি মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। দেশের প্রায় সব অঞ্চলে কম-বেশি নদীভাঙন চলছে। নদীর পানির প্রবাহপথ সঙ্কুচিত হবার ফলে স্রোতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়া এবং নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও নদীর গতিপথ পরিবর্তনসহ অন্যান্য কারণে দেশের প্রায় সকল প্রধান নদীতে ভাঙন চলছে। প্রতি বছর বিশেষ করে বন্যা মৌসুম ও সন্নিহিত সময়ে নদীভাঙন বাংলাদেশের প্রায় ৪০টি প্রধান ও অপ্রধান নদীতে অবধারিত ঘটনা হিসেবে দেখা দেয় ।
নদীভাঙনের ক্ষয়ক্ষতি :
নদীভাঙনের ক্ষয়ক্ষতি অপরিসীম। এর আর্থ-সামাজিক প্রতিক্রিয়াও অত্যন্ত মারাত্মক ও ভয়াবহ। নদীভাঙনের ফলে প্রতি বছর প্রায় ২০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। প্রতি বছর প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নদীভাঙনজনিত প্রতিক্রিয়ার শিকার হচ্ছে। ফলে কেবল জীবননাশই নয়, বসতবাড়ি, গোসম্পদ, গাছপালা, মূল্যবান চাষযোগ্য জমি এবং অন্যান্য পারিবারিক সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এছাড়াও নদীভাঙনের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া আরো দীর্ঘমেয়াদি। নদীভাঙনের ফলে অনেক পরিবার তাদের সামাজিক মান-মর্যাদা ও অর্থনৈতিক মান রক্ষায় বিপর্যস্ত হচ্ছে, মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের মাঝে অনেকের লেখাপড়া, ব্যবসা-বাণিজ্য হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে এবং অনেকের পেশাগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। এক কথায় বলা যায়, নদীভাঙন বাংলাদেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারায় অপরিসীম ক্ষয়ক্ষতি সৃষ্টি করছে।
ভূমিকম্প
প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ভূমিকম্পও বহু
শতাব্দী ধরে বাংলাদেশে আঘাত হানছে। ভূতাত্ত্বিকরা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ভূমিকম্পপ্রবণ
এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর এই এলাকার
আওতাভুক্ত ।
ভূমিকম্পের কারণ :
সাধারণত কঠিন ভূ-ত্বকের কখনো কখনো হঠাৎ কেঁপে উঠাকে
বলা হয় ভূমিকম্প । কয়েকটি প্রধান কারণে ভূমিকম্প হয়ে থাকে । যেমন—
ক. কোনো কারণে পৃথিবীর অভ্যন্তরে শিলাচ্যুতি
ঘটলে তাপ বিকিরণের ফলে ভূগর্ভ সঙ্কুচিত হয়ে ভূত্বকে ভাঁজের সৃষ্টি হলে ভূমিকম্প হয়
।
খ. ভূগর্ভে চাপ কঠিন অবস্থা থেকে তরল অবস্থায়
পরিণত হয়
গ. আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় লাভা
বের হওয়ার ফলে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে ।
ঘ. প্লেট মুভমেন্টের কারণে ভূমিকম্প হয়ে
থাকে। ভূত্বক কতগুলো প্লেট দ্বারা নির্মিত। এসব প্লেটের ভূতাত্ত্বিক নাম ‘টেকটোনিক প্লেট’। এছাড়া রয়েছে
অসংখ্য সাবপ্লেট। এগুলো সবসময় সঞ্চরণশীল। প্লেটগুলো চলতে চলতে কখনো যদি একটি অন্যটিকে
অতিক্রম করে ফেলে কিংবা একটি অন্যটির গায়ে চড়ে বসে তখনি ভূমিকম্প হয় ।
ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতিঃ
ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি অত্যন্ত ভয়াবহ
ও ব্যাপক । ভূমিকম্পের ফলে বাড়িঘর, দালানকোঠা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়, গাছপালা ভেঙে
পড়ে, নদীর পাড় ভেঙে পড়ে, নদীর বাঁধ-জলাধার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিদ্যুৎ ব্যবস্থায়
বিঘ্ন ঘটে, মাটিতে ফাটল দেখা দেয়, পাহাড়ে ধস নামে, নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয় । সর্বোপরি
এর ফলে জীবন ও সম্পদের অপরিসীম ক্ষতি হয়।
ভূমিকম্পের
ঝুঁকিতে বাংলাদেশ :
বাংলাদেশ বর্তমানে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে
রয়েছে। সাম্প্রতিককালে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় সংঘটিত ভূমিকম্প
একটি বড় ধরনের ভূমিকম্পেরই পূর্বাভাস দিচ্ছে। অতীতে বাংলাদেশে প্রচণ্ড ভূমিকম্প হয়েছে।
এর মধ্যে ১৮৬০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ২০টি উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্পের রেকর্ড রয়েছে।
১৭৬২ সালে বাংলাদেশে যে ভূমিকম্প হয় তাতে মধুপুরের গড় ও সিলেটের হাওর সৃষ্টি হয়
বলে ধারণা করা হয়। ১৭৮৭ সালের ভূমিকম্পে তিস্তা নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়। ১৮৮৭ সালের
ভূমিকম্পের প্রভাবে বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তিত হয়। এছাড়াও ১৮৮৫
সালের বেঙ্গল ভূমিকম্প, ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গলের ভূমিকম্প এবং ১৯৩০ সালের ধুবরীর ভূমিকম্পে
ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৩০ থেকে ৩৫টি মৃদু ভূমিকম্প হয় ।
ঝুঁকিপূর্ণ
শহর ঢাকা :
জাতিসংঘ প্রণীত ভূমিকম্প বিপর্যয়ের ঝুঁকি সূচকে (আর্থকোয়েক ডিজাস্টার রিঙ্ক ইনডেক্স, সংক্ষেপে ইডিআরআই) পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে এক নম্বরে রয়েছে ঢাকা শহর। এর একমাত্র কারণ এখানকার বাড়িঘরের নিম্নমান। বিশেষজ্ঞদের মতে, রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের সর্বোচ্চ ইনটেনসিটি যদি ঢাকায় অনুভূত হয়, তাহলে এখানকার প্রায় ৪০ শতাংশ বাড়িঘর বিধ্বস্ত হবে। প্রায় ১৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হবে আর অজস্র প্রাণহানি ঘটবে । তাই এ ব্যাপারে এখনই সর্বোচ্চ সতকর্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার ।
উপসংহার :
প্রাকৃতিক দুর্যোগ
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা। নানা কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশে পরিণত হয়েছে
বাংলাদেশ । প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ দেশকে অগ্রগতির ধারা থেকে পিছিয়ে দিচ্ছে। বিভিন্ন
ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের দ্বারা প্রতি বছরই এ দেশের জনগণের জান-মাল, সহায়-সম্পত্তি,
প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপুল ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। যদিও এই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে কখনো স্তব্ধ
করা যাবে না, তবুও পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের মতো এ দেশেও পরিকল্পিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
কাঠামো গড়ে তোলার দ্বারা এর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য
সরকারকে যেমন দুর্যোগ প্রতিরোধে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে, তেমনি দেশের জনগণকেও সচেতন
হয়ে দুর্যোগ মোকাবিলায় অধিকতর সচেষ্ট হতে হবে ।