এ. কে. ফজলুল হক কে ছিলেন? সমাজকল্যাণে তার অবদান বর্ণনা কর ।

 

এ. কে. ফজলুল হক কে ছিলেন? সমাজকল্যাণে তার অবদান বর্ণনা কর ।

এ. কে. ফজলুল হক কে ছিলেন? সমাজকল্যাণে তার অবদান বর্ণনা কর ।


ভূমিকা :

ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজসংস্কার ও সমাজকল্যাণের সুবৃহৎ পরিসরে যে কয়জন পরহিতৈষী ও সমাজসংস্কারক আপন মহিমায় উজ্জল হয়ে আছেন, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। রাজনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা ও কৃষি এবং নিপীড়িত ও শোষিত জনগণের মুক্তির ক্ষেত্রে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তাই তাকে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে অমরত্ব দান করেছে। তিনি মৃত্যু পর্যন্ত বাংলার অবহেলিত ও বঞ্চিত জনগণের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে গেছেন।

সমাজকল্যাণ ও সমাজসংস্কার ক্ষেত্রে এ. কে. ফজলুল হকের অবদান :

নিম্নে সমাজকল্যাণ ও সমাজসংস্কার ক্ষেত্রে শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হকের অবদান আলোচনা করা হলো:

. কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা :

১৮৭৫ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ কর্তৃক আলীগড় এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজকে ১৯২০ সালে 'আলীগড় মুসলিম বিশ্বাবিদ্যালয়' এ উন্নীত করা হয় এবং ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি নেতৃস্থানীয় উদ্যোক্তার ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৪ সালে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে কলকতায় ইসলামিয়া কলেজ এবং মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের আর্থিক সাহায্যদানের জন্য 'মুসলিম এডুকেশনাল ফান্ড' গঠন করেন এবং তার আমলেই 'স্কুল ও মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড গঠনের বিল আনীত হয় ।

২. সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মুসলিম এডুকেশনার এসোসিয়েশন গঠন :

১৯১২ সালে ফজলুল হক মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের জন্য বাংলার গভর্নরের কাছ থেকে বৃত্তি এবং আর্থিক সাহায্য লাভ করার লক্ষ্যে 'সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মুসলিম এডুকেশনাল এসোসিয়েশন গঠন করেন। কলকাতায় 'কারমাইকেল ও টেলর হোস্টেল প্রতিষ্ঠায় ফজলুল হক সক্রিয় সহযোগিতা প্রদান করেন ।

৩. শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ :

১৯২৪ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক বেশ কয়েকবার মন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। প্রতিবারই তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নিজ দায়িত্বে রেখেছিলেন। বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে তার অবদান অনন্য। ১৯৬০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত 'মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন' এর অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। ১৯১২ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদে উত্থাপিত 'শিক্ষা পরিকল্পনা বিল' এদেশে শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। বাংলা একাডেমি এবং বুলবুল ললিতকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা এদেশের সংস্কৃতির উন্নয়নে তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর বহন করেছে।


৪. মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি গঠন : 

শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক মুসলমানদের শিক্ষাবিস্তারের মাধ্যমে এদেশে একটি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি গঠনের চেষ্টা করেন। উপমহাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা মুসলমানদের হাত থেকে ইংরেজদের হাতে চলে যাওয়ার পর প্রায় দেড়শ বছর মুসলমানরা ইংরেজদের সহিত অসহযোগিতা ও তাদের সবকিছু বর্জন করতে থাকে। 

ফলে মুসলমানগণ শিক্ষার আলো থেকে যেমন বঞ্চিত হতে থাকে, তেমনি রাষ্ট্রপরিচালনার সব ধরনের সুযোগ সুবিধাও হারাতে থাকে কিন্তু এ সুযোগ অন্যান্য সম্প্রদায় বিশেষত হিন্দুসমাজ ইংরেজদেরকে বিভিন্ন সহযোগিতা করতে থাকে। সে কারণে তুলনামূলকভাবে মুসলমানরা শিক্ষাদীক্ষায় অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। 

তাই এ সময় শক্তিশালী মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির মধ্যে বাঙালি মুসলমানরা অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি। এমনি সময় রাজনীতিতে আবির্ভূত হন শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। তিনি কৃষকদের অর্থনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার সাথে সাথে শিক্ষাবিস্তারের মাধ্যমে বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।

৫. শিক্ষা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ :

শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক শিক্ষা সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল, বরিশালে চাখার ফজলুল হক কলেজ, রাজশাহীতে আদিনা ফজলুল হক কলেজ সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজও তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর বহন করেছে। 

ঢাকার ইডেন কলেজ প্রতিষ্ঠায় তার অবদান ছিল ন অপরিসীম। শিক্ষার ব্যাপারে ফজলুল হকের উদ্যম ও উৎসাহ লক্ষ করে তৎকালীন ডিপিআই হরনেল সাহেব শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের যথেষ্ট প্রশংসা করে তাকে 'বেনথাম অব বেঙ্গল' নামে আখ্যায়িত করেন।

৬. কৃষক-প্রজা পার্টি গঠন :

১৯৩৫ সালে স্যার আবদুর রহিম কেন্দ্রীয় আইনসভার সভাপতি নির্বাচিত হলে শেরে বাংলা এ. কে. প্রজা সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। পূর্ববাংলার মধ্যবিত শ্রেণির শিক্ষিত নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ মানুষ ফজলুল হকের সমর্থক হয়ে ওঠে। 

অল্প সময়ের মধ্যেই প্রজা আন্দোলন এক গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং ফজলুল হক মধ্যবিত্ত, সাধারণ প্রজা ও কৃষকদের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। ১৯৩৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রজা সম্মেলন শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সবাভাপতিত্ব করেন এবং এ সম্মেলনে কতিপয় সদস্য দাবি করেন যে, প্রকৃত কৃষকদের এ সমিতির সদস্য করার ব্যবস্থা করা হোক । তদনুযায়ী একটি প্রস্তাব পাস হয় এবং প্রজা সমিতির নাম পাল্টিয়ে এর নাম কৃষক-প্রজা পার্টি।


৭. কৃষক-প্রজা আন্দোলন :

জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণের হাত থেকে কৃষকদের মুক্ত করার লক্ষ্যে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদে তিনি ব্যাপক কর্মপ্রচেষ্টা চালান। অবহেলিত ও অশিক্ষিত কৃষকদের রাজনৈতিক দিক থেকে সচেতন করে তোলার জন্য তিনি বিশ শতকের প্রথমার্ধে ‘কৃষক-প্রজা আন্দোলন' গড়ে তোলেন ।

৮. কৃষক-প্রজা সমিতির গঠন :

১৯২৮ সালে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক বঙ্গীয় আইনসভায় 'বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব' আইন পাস করেন। কিন্তু আইনসভায় অধিকাংশ সদস্য জমিদার হওয়ায় এ আইনে কৃষকদের স্বার্থ অনেকটা উপেক্ষিত হয়। ফলে কৃষক-প্রজাদের দাবিদাওয়া সাংগঠনিকভাবে প্রচার ও তা আদায় করার লক্ষ্যে ফজলুল হক ১৯২৯ সালে 'নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি' গঠন করেন। এ সমিতি গঠনের ফলে বাংলায় কৃষক ' সংগঠন ও আন্দোলন যথেষ্ট জোরদার হয়ে ওঠে।

৯. জমিদারি প্রথার বিলোপ সাধন :

শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের যৌক্তিকতা অনুসন্ধানের জন্য ফ্রান্সিস ফ্লাউডকে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করেন। ফ্লাউড কমিশন ১৯৪০ সালে জমিদারি প্রথা বিলোপের জন্য সুপারিশ করে এবং জমিদারির দেয় রাজস্বের অনুপাতে এর ৫-১০ গুণ ক্ষতিপূরণস্বরূপ জমিদাকে দেওয়ার প্রস্তাব করে। ফ্লাউড কমিশনের সুপরিশেরে ফজলুল হক জমিদারি প্রথা বিলোপের জন্য আইনসভায় একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন ।

কেন্দ্রীয় সরকারের কারণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ তখনো সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ফজলুল হক জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের জন্য শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলেন। অবেশেষে ১৯৫০ সালে East Bengal State Acquisition Act এর অধীনে জমিদারি প্রথার বিলোপ ঘটে। এ সিদ্ধান্তের মূলে ছিল শেরে বাংলার দীর্ঘদিনের 'কৃষক-প্রজা আন্দোলনের' সুদূরপ্রসারী প্রভাব।

 

উপসংহার :

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, এদেশের গতানুগতিক সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে বঞ্চিত ও উপেক্ষিতদের স্বার্থ সংরক্ষণে, শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতা প্রসারের মাধ্যমে সমাজ প্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এক অনন্য সাধারণ কর্মীপুরুষ শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। তার অপরিসীম অবদান মূল্যায়নে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারপতি রাধিকা রঞ্জন গুহ মন্তব্য করেন, ফজলুল হক আমেরিকায় জন্ম নিলে হতেন ওয়াশিংটন, বিলেতে জন্ম নিলে হতেন ডিসরেলি, রাশিয়ার জন্ম নিলে হতেন লেনিন এবং ফ্রান্সে জন্ম নিলে হতেন রুশো কিংবা নেপোলিয়ন।”

 


Post a Comment

Previous Post Next Post