সমাজকর্মের দার্শনিক মূল্যবোধসমূহ আলোচনা কর ।

 সমাজকর্মের দার্শনিক \সাধারণ মূল্যবোধসমূহ আলোচনা কর ।
 

সমাজকর্মের দার্শনিক \সাধারণ মূল্যবোধসমূহ আলোচনা কর ।


ভূমিকা : 

সমাজকর্মের 'প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে সমাজকর্মের মূল্যবোধসমূহ। এ মূল্যবোধসমূহ অনুসরণ করেই পেশাদার সমাজকর্মের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। এটি মানুষের আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণের চালিকাশক্তি ও জীবনের দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করে। সমাজকর্ম হচ্ছে এমন একটি পেশা যে পেশায় মূল্যবোধসমূহ পৃথিবীর অন্যান্য পেশা থেকে স্বকীয়তা দান করে । সমাজকর্মীরা সমাজস্থ মানুষের কল্যাণে তাদের নিজেদের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিলব্ধ জ্ঞান প্রয়োগ ও অর্জিত দক্ষতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমাজকর্মের দার্শনিক মূল্যবোধসমূহ অনুসরণ করে থাকে। 


সমাজকর্মের দার্শনিক মূল্যবোধসমূহ : 

নিম্নে সমাজকর্মের দার্শনিক মূল্যবোধসমূহ আলোচনা করা হলো-


১. ব্যক্তির স্বাভাবিক মূল্য ও মর্যাদার স্বীকৃতি :


সমাজস্থ প্রতিটি মানুষের সহজাত মূল্য রয়েছে। ব্যক্তির প্রকৃত মূল্য ও মর্যাদার যথাযথ স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে সমাধান প্রক্রিয়া ও উন্নয়নে অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। এতে ব্যক্তির সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটে, আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে এবং তিনি স্বাবলম্বী হওয়ার মাধ্যমে সামাজিক ভূমিকা পালনে সক্ষম হন । তাই সমাজকর্মের অন্যতম মূল্যবোধ হলো ব্যক্তি সহজাত মূল্য ও মর্যাদার স্বীকৃতি ।


২. ব্যক্তিস্বাধীনতা : 


আধুনিক সমাজকর্মের একটি অন্যতম মূল্যবোধ হলো ব্যক্তিস্বাধীনতা। সমাজকর্ম ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী আর ব্যক্তিস্বাধীনতা হলো অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে ব্যক্তির ইচ্ছানুযায়ী কাজ করার ক্ষমতা প্রদান করা। কেননা 'ব্যক্তি যা চায় তাকে তা করতে দাও'। একথার অর্থ হচ্ছে স্বাধীন ও মুক্ত চিন্তা, মতামত প্রকাশ, বিশ্বাস রাখাতে কার্যসম্পাদন করা প্রভৃতি সব বিষয়ে ব্যক্তি স্বাধীন ও সার্বভৌম। কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ, আধিপত্য বিস্তার ও বলপ্রয়োগ করা ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থি।


৩. আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার :


 সমাজকর্ম একটি মানব সেবা প্রদানকারী পেশা। এটি চায় ব্যক্তির চাহিদা চিহ্নিত করে তা পূরণ করা এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা বা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা। যেন ব্যক্তি তার সমস্যা সমাধান করে স্বনির্ভর ও আত্মবিশ্বাসী হতে পারে। সমাজকর্ম এ নীতির ওপর বিশ্বাসী যে প্রতিটি মানুষের মধ্যেই সুপ্ত প্রতিভা রয়েছে। এ সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হলেই মানুষ তার নিজের সামর্থ্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাবে।


৪. সবার জন্য সমান সুযোগ দান : 


সমাজকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ হলো সবার জন্য সমান সুযোগ দান। এটি চায় জাতিধর্মবর্ণ শ্রেণিনির্বিশেষে সব মানুষকে সমান সুযোগ দানের মাধ্যমে একটি সুন্দর ও মননশীল গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে। কেননা সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে যদি ভেদাভেদ ও বৈষম্য পরিলক্ষিত হয় তাহলে প্রকৃত সেবাদান করা সম্ভব হয় না। তাই সমাজকর্মে প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধার সমবণ্টনের মাধ্যমে সাহায্যার্থীর সম্ভাবনার বিকাশ ঘটে এবং হতাশা দূর হয়।   

৫. গণতান্ত্রিক অধিকার : 


সমাজকর্ম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নীতিতে বিশ্বাসী। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রাধান্য দেয় বলেই সমাজকর্ম প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছা, মতামত, সিদ্ধান্ত, দৃষ্টিভঙ্গি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও কর্ম স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয়ে যথাযথ মূল্যায়ন করে। গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার স্বার্থে সমাজকর্ম ব্যক্তিগত স্বার্থকে অগ্রাহ্য করে জনগণের সমষ্টিগত স্বার্থকে মূল্য দেয়। এতে জনগণের আত্মবিশ্বাস মজবুত হয়। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত এবং পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয় ।


৬. স্বনির্ভরতা অর্জন : 


নিজের ওপর নিজে নির্ভরশীল হওয়াকে স্বনির্ভরতা বা আত্মনির্ভরশীলতা বলে । আত্মনির্ভরশীল ব্যক্তি অন্যের সাহায্যের অপেক্ষায় না থেকে নিজের যোগ্যতা ও সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হয়। আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন সমাজকর্মের পূর্বশর্ত। তাই সমাজকর্ম তার সব কর্মকাণ্ডই স্বাবলম্বন নীতির আলোকে পরিচালনা করা হয়, সাহায্যার্থী স্থায়ীভাবে যেকোনো সমস্যা সমাধান করতে পারে। আর স্বনির্ভর সমাজ গঠনে সমাজকর্মীর অবদান অনস্বীকার্য ।


৭. সামাজিক দায়িত্ব : 


সমাজকর্মের অন্যতম মূল্যবোধ হলো মানুষের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করা। কেননা মানুষ সমাজ থেকে যেমন অনেক উপকার লাভ করে তেমন সমাজের প্রতিও তার কিছু দায়দায়িত্ব রয়েছে। এসব সামাজিক দায়দায়িত্ব পালন ব্যতীত সামাজিক সুযোগ সুবিধা ভোগ করা যায় না। তাই সমাজকর্ম বিশ্বাস করে যে ব্যক্তি নিজের বা পরিবারের প্রতি তথা সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সামাজিক বা উন্নয়নে অংশগ্রহণ করে, যা পরবর্তীতে সামাজিক দায়িত্ববোধে পরিণত হয়।


৮. সম্পদের সদ্ব্যবহার : 


আধুনিক সমাজকর্ম একটি সক্ষমকারী পেশা। এতে ব্যক্তিগত, দলীয় ও সমষ্টিগত পর্যায়ে বস্তুগত ও অবস্তুগত উভয় সম্পদের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। এজন্যই সম্পদের সদ্ব্যবহার সমাজকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ। সমাজকর্ম বিশ্বাস করে সম্পদের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা সম্ভব ।


৯. শ্রমের মর্যাদা : 


শ্রমের মর্যাদা একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ সমাজকর্ম সমাজের সার্বিক মানুষের কল্যাণ এবং সমৃদ্ধময় সমাজ গঠনে বিশ্বাসী। এজন্য দরকার প্রচুর শ্রমের। সমাজ অনুমোদিত যেকোনো কাজ শ্রম, বৃত্তি বা পেশা যা মানহানিকর নয়। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই মানুষ তার লুক্কায়িত ক্ষমতার বিকাশ ঘটিয়ে নিজেই নিজের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটায়। এক্ষেত্রে দরকার কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের তাহলেই শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে।


১০. সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি :


 সমাজকর্ম সমাজের উন্নয়নের লক্ষে জাতিধর্মবর্ণ শ্রেণিনির্বিশেষে সব মানুষের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক, নৈতিক ও ধর্মীয় প্রভৃতি দিকের সামগ্রিক কল্যাণের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। এক্ষেত্রে সামাজিক মূল্যবোধের সাথে সমাজকর্ম মূল্যবোধের অভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং সমাজে সবার স্বার্থ সংরক্ষণ ও সবদিকের ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়নের জন্যই সমাজকর্ম সমাজ ও মানুষের প্রতি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে । তাই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজকর্মের খুবই মূল্যবান মূল্যবোধ।    


১১. গোপনীয়তা :


গোপনীয়তা হলো সমাজকর্মের একটি বিশেষ মূল্যবোধ, সমাজকর্মী সাহায্যার্থীর গোপনীয় বিষয়গুলো অত্যন্ত যত্নের সাথে হেফাজত করবে। সাহায্যার্থীর সাথে সম্পর্কে ক্ষেত্রে গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করা খুবই জরুরি। 


উপসংহার :


আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উপরিউ মূল্যবোধগুলো হচ্ছে সমাজকর্মের প্রাণ। তাই সমাজকর্মীদে জন্য এ মূল্যবোধগুলোর অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়। কেননা এস মূল্যবোধ সমাজকর্মীদের জন্য চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সমাজকর্মের মূল্যবোধসমূহ যেকোনো সমাজের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় রীতিনীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তাই সমাজের সার্বিক উন্নয়ন পরিবেশের স্থিতিশীলতা রক্ষা জন্য সমাজকর্ম মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য ।

 

 

Post a Comment

Previous Post Next Post