বাংলাদেশ সরকারের শিশুকল্যাণ কার্যক্রম আলোচনা কর।
ভূমিকা :
দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার হিসেবে শিশুরাই আগামী দিনের দায়িত্ব বহন করবে। তাই শিশুদের সুষ্ঠু কল্যাণের ওপরই নির্ভর করে যেকোনো দেশ ও জাতির সমৃদ্ধ, উন্নয়ন ও সার্বিক কল্যাণ। এজন্য শিশুকল্যাণের ওপর পৃথিবীর সব দেশেই বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। দেশ ও জাতির স্বার্থেই শিশুদের উপযুক্ত যত্ন ও পরিচর্যার মাধ্যমে গড়ে তুলতে হবে। আর সে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকার শিশুদের রক্ষণ, শিশুশিক্ষা, গঠনমূলক সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ এবং সেগুলোর বাস্তবায়ন করে চলেছে।
বাংলাদেশ সরকারের শিশুকল্যাণ কার্যক্রম :
বাংলাদেশ সরকার শিশুদের জন্য যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করেছে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১. সরকারি শিশুসদন :
১৯৪৩ সালের অরফ্যান এন্ড উইডোস অ্যাক্ট অনুসারে সমাজসেবা অধদপ্তরের আওতায় সরকারি শিশুসদন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ শিশুসদন বর্তমানেও চালু আছে। এ. শিশুসদন পিতামাতাহীন পথ শিশু, যারা বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ, নিখোঁজ প্রভৃতি কারণে অসহায় ও পরিত্যক্ত তাদের নিরাপত্তা, রক্ষণাবেক্ষণ, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৮৫টি সরকারি শিশুসদন পরিচালিত হচ্ছে। এখানে শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণ, প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান ও বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষার্জনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। সাধারণত ৫-১৮ বছর বয়সসীমা পর্যন্ত এতিম শিশুদেরকে এসব শিশু সদনে রাখার বন্দোবস্ত করা হয়।
২. শিশু পরিবার :
বাংলাদেশ সরকারের শিশুকল্যাণমূলক কার্যক্রমের মধ্যে শিশু পরিবার গঠন একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। পারিবারিক পরিবেশে শিশুদেরকে লালনপালনের লক্ষ্যে বর্তমানে দেশের ২৩টি শিশুসদনকে শিশু পল্লির আঙ্গিকে শিশু পরিবারে রূপান্তরিত করা হয়। বর্তমানে সারা দেশে মোট ২,৮০০ জন এতিম শিশুর জন্য ১১২টি শিশু পরিবার গঠন করা হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে অবশিষ্ট ৫০টি শিশুসদনের শিশুদের জন্য শিশু পরিবার গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
৩. শিশুর বিকাশে প্রারম্ভিক শিক্ষা :
শিশুকল্যাণের লক্ষ্যে এ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি দেশের ৬৪টি জেলায় শিশুর স্বাভাবিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে ষ্টি বিভিন্নমুখী শিক্ষামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পের উদ্যোগে ২০১১-১২ অর্থবছরে ১৫০ টি প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। সমগ্র দেশব্যাপী ৪-৫ বছর বয়সি প্রায় ৮ লক্ষ শিশুকে ৮,৭৩১ টি কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করা হয়েছে।
৪. শিশু সংরক্ষণ কেন্দ্র বা বেবিহোম :
সুবিধাবঞ্চিত, পরিত্যক্ত, অবহেলিত এবং ঠিকানাবিহীন শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে বর্তমানে তিনটি বেবিহোম চালু রয়েছে। এ বেবি হোমগুলো যথাক্রমে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে অবস্থিত। এসব প্রতিষ্ঠানে শিশুদের পাঁচ বছর পর্যন্ত পরিচর্যা করা হয়। পাঁচ ধবীর বছর পূর্ণ হলে এদের সরকারি শিশুসদনে পাঠানো হয় ।
৫. দুস্থ শিশুদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র :
১৯৮১ সালে গাজীপুর জেলার কোনাবাড়িতে দেশের দুস্থ শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণ, ামনে প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ৪০০ আসনবিশিষ্ট দুস্থ শিশুদের মূলক প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করা হয় । এ কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠার লোর পর থেকে ৪৭৯ জন দুস্থ শিশুকে সমাজে যথাযথভাবে পুনর্বাসিত করা হয় । তবে এ কেন্দ্র কেবল ছেলে শিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়, দেশের দুস্থ মেয়ে শিশুরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত ।
৬. প্রবেশন কর্মসূচি :
দেশের অপরাধী শিশুদের সংশোধনের মাধ্যমে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনে সমাজে পুনর্বাসিত করার উদ্দেশ্যে প্রবেশন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী শিশুদের সাজা স্থগিত রেখে সৎপথে পরিচালনার জন্য বাংলাদেশে ২টি প্রবেশন কেন্দ্র চালু রয়েছে।
৭. মাতৃমঙ্গল ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র :
শিশুকল্যাণের উদ্দেশ্যে গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্রসূতির জন্য শয্যার ব্যবস্থা এবং মা ও শিশু চিকিৎসার ব্যবস্থার জন্য বাংলাদেশে ৬৪টি জেলা সদরে অবস্থিত ৬৪টি মাতৃমঙ্গল' ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র থেকেও মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় চিকীৎসা সেবা দেওয়া হয় ।
৮. কিশোর অপরাধ সংশোধন কার্যক্রম :
আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির আইনের যুগে শিল্পায়ন ও শহরায়নের প্রভুত উন্নতির সাথে পাল্লা দিয়ে কিশোর অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব কিশোর অপরাধীদের চরিত্র সংশোধন ও পুনর্বাসনের জন্য ঢাকার টঙ্গীতে কিশোর অপরাধ সংশোধন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
চতুর্থ প্রবেশন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা মেয়াদে যশোরে ১৫০ আসনবিশিষ্ট দ্বিতীয় কিশোর সংশোধনী কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও বরিশালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে আরও তিনটি কিশোর অপরাধ সংশোধন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। দেশে কিশোর অপরাধ সংশোধনের ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে ।
৯. প্রতিবন্ধী শিশুকল্যাণ কার্যক্রম :
বাংলাদেশ সরকার শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় ৪টি প্রতিবন্ধী শিশুকল্যাণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এসব কেন্দ্রের আওতায় ৫টি অন্ধ স্কুল, ৭টি মুক ও বধির স্কুল, ৫টি বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু রয়েছে। সারা দেশে অন্ধ শিশু কিশোরদের জন্য ৪৭টি সমন্বিত অন্ধ শিক্ষা প্রকল্প রয়েছে। এছাড়াও অটিস্টিক শিশুদের জন্য জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ২০১১ সালে একটি সম্পূর্ণ অবৈতনিক অটিস্টিক স্কুল চালু করা হয়।
১০. বিপন্ন শিশুদের কল্যাণ :
ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা ও নারায়ণগঞ্জে দেশের বিপন্ন ও অভিভাবকহীন কর্মজীবী শিশুদের প্রে কল্যাণে বিভিন্ন কর্মসূচিটি পরিচালিত হচ্ছে। এসব কর্মসূচির লক্ষ্য হচ্ছে বিপন্ন শিশুদের বিভিন্ন বৃত্তিমূলক ও কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত করে আত্মনির্ভরশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শিশু তহবিল, শিশু অধিকার ফোরাম, মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয় সহায়তা প্রদান করছে।
উপসংহার :
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে,
শিশুকল্যাণের উল্লিখিত কর্মসূচির বাইরেও সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের পরিচালনাধীন . আরও
কিছু কর্মসূচি রয়েছে যা পরোক্ষভাবে শিশুকল্যাণের সাথে সম্পর্কযুক্ত। যেমন-
বিদ্যালয় সমাজকর্ম, মাতৃকেন্দ্র, পৌর সমাজসেবা ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশে শিশুদের
তুলনায় শিশুকল্যাণ কর্মসূচি খুবই অপ্রতুল। তাই দেশ ও জাতির সামগ্রিক কল্যাণের
স্বার্থে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে শিশুকল্যাণে গৃহিত কর্মসূচির ব্যাপক
সম্প্রসারণ করা একান্ত জরুরী।