সমালোচনাসহ মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ ১৯৬১ এর ধারাসমূহ বর্ণনা কর।

সমালোচনাসহ মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ ১৯৬১ এর ধারাসমূহ বর্ণনা কর।

সমালোচনাসহ মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ ১৯৬১ এর ধারাসমূহ বর্ণনা কর।


ভূমিকা:


প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় বিরাজমান অপ্রত্যাশিত ও অবাঞ্ছিত অবস্থা নির্মূল করে সমাজের কাঙ্ক্ষিত ও বাঞ্ছিত পরিবর্তন আনয়ন এবং সর্বস্তরে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও নিরাপদ জীবন গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রণীত আইনই হলো সামাজিক আইন। বাংলাদেশে প্রণীত বিভিন্ন সামাজিক ও জননিরাপত্তামূলক আইনের মধ্যে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অন্যতম। মুসলিম সমাজে বহুবিবাহ, তালাক, ভরণপোষণ, উত্তরাধিকার ইত্যাদি পারিবারিক বিষয় ও পারিবারিক ভাঙন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক প্রণয়ন করা হয়।


১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের ধারা:  নিম্নে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের ধারা বা অধ্যাদেশসমূহ আলোচনা করা হলো-


ধারা-১, নাম সংক্ষেপ, এলাকা প্রয়োগ ও প্রারম্ভ: এ অধ্যাদেশ ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন বলে অভিহিত হবে।  এর আওতা হবে সমগ্র বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের সব মুসলিম নাগরিকের ওপর এটি প্রযোজ্য হবে। সরকার এ সম্পর্কে সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপনে যে তারিখ নির্ধারণ করেন সেই তারিখ তা কার্যকর হবে।


ধারা-২, সংজ্ঞায়ন: এ অধ্যাদেশে বিষয় বা পূর্বাপর কথার বরখেলাপি কোনোকিছু না থাকলে-


ক. সালিশি পরিষদ বলতে চেয়ারম্যান ও এ অধ্যাদেশে ব্যবহূত কোনো বিষয়ের সাথে যুক্ত পক্ষগণের প্রত্যেকের একজন প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত কোনো সভাকে বুঝায়।

খ. চেয়ারম্যান বলতে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার চেয়ারম্যান, পৌর কর্পোরেশনের মেয়র বা প্রশাসক এবং এ অধ্যাদেশের অধীনে চেয়ারম্যানদের কর্তব্য পালন করার জন্য সরকার কর্তৃক নিযুক্ত ব্যক্তিকে বুঝায়।

গ. পৌরসভা বলতে ১৯৭৭ সালে পৌরসভা অধ্যাদেশের অধীনে গঠিত এবং কথিত বিষয়ে যথানির্ধারিত এখতিয়ারের অধিকারী কর্তৃপক্ষকে বুঝায়।


ধারা-৩, অন্যান্য আইন ইত্যাদি বাতিল করার অধ্যাদেশঃ  অন্য কোনো আইন, প্রথা বা নীতি বর্তমান থাকা সত্ত্বেও এ অধ্যাদেশের বিধানাবলি কার্যকর হবে।


ধারা-৫, বিবাহ রেজিস্ট্রি করা: ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে প্রতিটি বিয়ে রেজিস্ট্রিভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এজন্য প্রত্যেক ইউনিয়নে একজন করে নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগ করার বিধান রাখা হয়। তিনি বিয়ে রেজিস্ট্রি করার সাথে সাথে তার রেজিস্টার সংরক্ষণও করেন।  এ উদ্দেশ্যে প্রত্যেক অঞ্চলে সরকার অনুমোদিত কাজি অফিস ও একজন রেজিস্ট্রার থাকবে।


ধারা-৬, বহুবিবাহ: সালিশি বোর্ডের অনুমিত ছাড়া কোনো পুরুষ একটি বিবাহ বলবৎকালীন অপর বিয়ে করতে পারবে না (উপধারা-১)। উল্লেখ্য, অনুমতিবিহীন এ ধরনের বিবাহ মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইনে রেজিস্ট্রি হয় না। একাধিক বিবাহের জন্য বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীগণের অনুমতি এবং নির্দিষ্ট ফি জমা দিয়ে চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করতে হয় (উপধারা- ২)। ৬নং ধারার ৪নং উপধারায় বলা হয়েছে যে, চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য বলে মনে না হলে মুন্সেফের নিকট পুনঃবিচারের আবেদন করা যাবে। এক্ষেত্রে মুন্সেফের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।

 

ধারা-৭, তালাকঃ তালাক সম্পর্কিত ধারার ১নং উপধারা অনুযায়ী কোনো পুরুষ স্ত্রীকে তালাক প্রদান করলে যথাশীঘ্র সম্ভব চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে জানাবে এবং স্ত্রীকে তার নকল প্রদান করবে। কোনো বারি ১নং উপধারা লঙ্ঘন করলে ১ বছরের বিনাশ্রম কারাদন্ড অথবা দশ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দন্ডিত হবে।

উপধারা ১নং অনুযায়ী নোটিশ প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান সংশ্লিস্ট দুই পক্ষের সমন্বয়ে সালিশি বোর্ডের ঘার পুনর্মিলনের চেষ্টা করবে। তবে নোটিশ প্রদানের ৯০ দিন পার হলে কিংবা ৩০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান পুনর্মিলন ঘটাতে বার্ণ হলে তালাক কার্যকর হয়ে পড়ে। তবে গর্ভবর্তী স্ত্রীর ক্ষেত্রে তালাক কার্যকর হয় সন্তান প্রসবের পর।


ধারা-৯, খোরপোশ: স্বামী তার স্ত্রী বা স্ত্রীদের খোরপোশ দিয়ে বার্থ হলে কিংবা খোরপোশের দাবি পূরণ না হলে স্ত্রী বা স্ত্রীগণ চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করতে পারবে। এ বিষয়ে সালিশি বোর্ড খোরপোশের পরিমাণ নির্ধারণ করে সার্টিফিকেট ইসু্যু করতে পারবে। এ ধারার ২ নং উপধারা অনুযায়ী স্বামী বা স্ত্রী ইস্যুকৃত সার্টিফিকেট পুনর্বিবেচনার জন্য মুন্সেফের নিকট আবেদন করতে পারবে।

 

ধারা-১০, দেনমোহর: ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী সালিশ পরিষদের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিবাহ করলে প্রথম স্ত্রী তালাক দাবি করতে পারবে এবং স্ত্রীর দেনমোহরের টাকা পরিশেধে স্বামী বাধ্য থাকবে। অভিযুক্ত হলে স্বামী এক বছর কারাদন্ড অথবা এক হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবে। এ আইনের ধারা অনুযায়ী দেনমোহর প্রদানের পদ্ধতি সম্পর্কে নিকাহনামা বা বিবাহের উত্তনামায় বিশদ কিছু উল্লেখ না থাকলে দেনমোহরের মোট পরিমাণই চাহিবামাত্র আদায়যোগ্য বলে বিবেচিত হবে।

 

ধারা-১২, বিয়ের বয়স নির্ধারণ: ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯ এর ধারা সংশোধন করে ছেলে ও মেয়ের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স যথাক্রমে ২১ ও ১৮ বছরের পরিবর্তে ১৮ ও ১৬ বছর করা হয়। ১৯৭৪ সালে এটি সংশোধন করে ছেলে ও মেয়ের বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স যথাক্রমে ২১ ও ১৮ নির্ধারণ করা হয়।


১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের সবল দিক বা গুরুত্ব :
 

নিম্নে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের সবল দিকসমূহ আলোচনা করা হলো—


১. ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনটি প্রণয়নের পূর্বে বিবাহের রেজিস্ট্রেশন না থাকায় তালাকপ্রাপ্ত মহিলারা লিখিত প্রমাণ উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হওয়ার ফলে দেনমোহরের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতো। কিন্তু ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন প্রবর্তিত হওয়ার পর বিবাহের রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে নারীদের অধিকার ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

২. প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ব্যতীত দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করার ক্ষেত্রে এ আইনটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। কেননা এটি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় বহুবিবাহ প্রথা সমাজ থেকে তিরোহিত হওয়ার পথ সুগম হয় ।

৩. এ আইনটি বাল্যবিবাহ রোধের ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। কারণ ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে ছেলেমেয়েদের বিবাহের বয়স নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে বাল্যবিবাহ কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব হয়েছে।

৪. ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে বিবাহকে একটি লিখিত চুক্তি হিসেবে গণ্য করায় স্ত্রীর মর্যাদা, অধিকার ও স্বাধীনতার প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন করা হয়েছে।

৫. এ আইনের মাধ্যমে বিধবা মহিলাদের অনিশ্চিত জীবনে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা লাভের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে ।

 ৬. এ আইনের মাধ্যমে সমাজ ও পারিবারিক জীবনে স্থিতিশীলতা ও শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।

৭. পারিবারিক ভাঙন রোধ করার ক্ষেত্রে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যার ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে।

৮. এ আইনে নির্দিষ্ট বিধিমালার আলোকে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী দেনমোহর লাভের অধিকার পায়।

 

 ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের দুর্বল দিক বা সীমাবদ্ধতা :

 

নারীদের অধিকার রক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের জন্য ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন প্রণয়ন করা হলেও তা সত্যিকার অর্থে নারীদের পুরোপুরি কল্যাণ বয়ে আনতে অপরাগ হয়। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও প্রচলিত সামাজিক অনুশাসনের প্রভাবে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনটির কার্যকারিতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। নিম্নে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের দুর্বল দিকসমূহ আলোচনা করা হলো-


১. ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী অপরাধীর জন্য যে শাস্তির কথা বলা হয়েছে তা অপরাধের তুলনায় যথাযথ নয় ।

২. বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে এ আইনের মাধ্যমে স্ত্রীকে স্বামীর মতো ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি ।

৩. ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের মাধ্যমে বিবাহের যে বয়স নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে তা বাস্তবে কার্যকর করার জন্য যথাযথ ও যুগোপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি ।

৪. এ আইনের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের ওপর শুধু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কিন্তু পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।

৫. নারীনির্যাতন ও যৌতুক প্রথা দূরীকরণ ও অপরাধীর শাস্তি সম্পর্কে এ আইনে কোনো সুস্পষ্ট বিধান সংযোজন করা হয়নি ।

৬. জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে এ আইন অনুযায়ী পারিবারিক সর্বোচ্চ সন্তানসন্ততির সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়নি । অথচ বাংলাদেশে তা ছিল অপরিহার্য ।

৭. এ আইনে বিবাহের বয়স নির্ধারণ করা সত্ত্বেও জনগণ সতর্ক হচ্ছে না; বরং অভিভাবকরা কন্যার অনিচ্ছায় বিয়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্র বিয়ে বন্ধ করার তেমন কোনো কার্যকর বিধান এ আইনে সংযোজন করা হয়নি।

৮. এ আইনে জনগণের অগ্রগতি ও সচেতনতার জন্য কোনো প্রচারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

 

উপসংহার:


উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনটি নারী ও শিশুদের অধিকার রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। যে লক্ষ্যে এ আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল, তার সুফল এখনো নারীসমাজের নিকট পৌছায়নি। এ আইনের কার্যকর বাদবায়নে সহায়তাদানের লক্ষ্যে পারিবারিক অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ জারি করা হয়। এছাড়াও নারীনির্যাতন বিরোধী অধ্যাদেশ এবং যৌতুক ও নির্যাতন নিতেধ অর্ডিন্যান্স দুটি ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের দুর্বল দিকসমূহের প্রতিবিধান করতে সহায়তা করছে।

 


Post a Comment

Previous Post Next Post