সুদ কি ও মুনাফা কি ? সুদ ও মুনাফার মধ্যে পার্থক্য , সুদ ও মুনাফার বৈশিষ্ট্যগুলো
ভূমিকা :
পুঁজিবাদী
অর্থব্যবস্থায় সুদ একটি অত্যাবশ্যকীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুদ ছাড়া পুঁজিবাদী
বা প্রচলিত অর্থব্যবস্থার কথা চিন্তা করা যায় না। আর এ সুদের প্রচলন বহু
প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। আর মুনাফা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসার লভ্যাংশ। ইসলামি
শরিয়ায় সুদকে হারাম আর মুনাফা সম্পূর্ণ বৈধ বা হালাল বলা হয়েছে। মহাগ্রন্থ আল
কুরআনের ঘোষণা, “আল্লাহ ব্যবসাকে করেছেন হালাল আর সুদকে করেছেন হারাম।”
[সুরা আল বাকারা : ২৭৫]
সুদ কি :
রিবার
বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে সুদ। ইসলামি অর্থনীতিবিদদের মতে, “সমজাতীয়
সম্পদের বিনিময়ে কোনো একদিকের অতিরিক্ত অংশকে সুদ বলে।”
অন্যভাবে বলা যায়, একই মানের সমজাতীয় পণ্যসামগ্রী হাতে হাতে কমবেশি করে বিনিময়
করলে অতিরিক্ত অংশটিকে সুদ বলে ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা :
সুদের সংজ্ঞা প্রদান প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ঋণ কোনো মুনাফা আকর্ষণ করে তাই সুদ।
ইবনুল আরাবি (রহ.) বলেন, “রিবা তথা সুদ হচ্ছে সে বাড়তি দাম, যা কোনো মালের বিনিময় নয়।” [আহকামুল কুরআন, খণ্ড-৩, পৃ. ১৫৩]
আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি (রহ.) বলেন, “পারস্পরিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার বিনিময় ছাড়া মালের প্রবৃদ্ধিই সুদ বা রিবা ।” উমদাতুল কারি শরহি সহীহুল বুখারি, খণ্ড-১২, পৃ. ১৯৯]
আল্লামা ইব্ন হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, “পণ্য বা অর্থের বিনিময়ে প্রদেয় অতিরিক্ত পণ্য বা অর্থই রিবা বা সুদ।” [ফাতহুল বারী, খণ্ড-৪, পৃ. ২৫]
ইমাম আর রাজি (রহ.) বলেন, “মালের ওপর যে বাড়তি দাবি করা হয় তার নামই 'রিবা' বা সুদ।” [আত তাফসির আল কাবির]
'আল মুফাসাল ফি আহকামির রিবা' গ্রন্থে বলা হয়েছে, “সুদ তথা রিবা হচ্ছে সেই বাড়তি অর্থ যার বিনিময়ে ঋণদাতা ঋণ পরিশোধের সময়টা আরও কিছুদিনের জন্য বাড়িয়ে দেয়।” [আল মুফাসসাল ফি আহকামির রিবা, খণ্ড-১, পৃ. ৪]
মুনাফা কি :
মুনাফার আরবি প্রতিশব্দ 'রাবাহ'। এর অর্থ হলো ব্যবসায়ে নিয়োজিত পুঁজি বা ক্রয়মূল্যের অধিক মূল্যে বিক্রয়ের মাধ্যমে লাভ করা। এর বিপরীতে অবস্থান করেছে। ক্ষতি বা লোকসান বা ক্রয়মূল্য থেকে কম দামে কোনো পণ্য বিক্রি করা। অর্থনীতিতে মুনাফা বলতে সর্বমোট আয়বায়ের ধনাত্মক পার্থক্যকে বুঝায়। আর সর্বমোট আয় বলতে দ্রব্য ও সেবার বিক্রয় থেকে প্রাপ্ত অর্থকে বুঝায়।
ইসলামি
অর্থনীতি গ্রন্থাকার একেএম রফিকউদ্দিন এর মতে, “কোনো ব্যক্তি বা
প্রতিষ্ঠান ঋণদাতা হিসেবে ঋণগ্রহীতার সাথে সমানভাবে লাভ-লোকসানের ঝুঁকি বহন করে
বিনিয়োগকৃত অর্থের ওপর যে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করে তাকে মুনাফা বলে ।”
সুদ ও মুনাফার মধ্যে পার্থক্য
ইসলামের
প্রারম্ভিক যুগের মতো বর্তমানকালেও মানুষ সুদ ও মুনাফাকে সাদৃশ্যপূর্ণ মনে করলেও
মুনাফা ও সুদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :
১. সংজ্ঞাগত পার্থক্য :
কমমূল্যে পণ্য উৎপাদন বা ক্রয় করে বেশি মূল্যে বিক্রির মাধ্যমে যে অর্থ উপার্জন হয় তাকে মুনাফা বলে । আর ঋণদাতাপূর্বনির্ধারিত হারে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে আসল বা মূলের অধিক যে অর্থ আদায় করে তাই সুদ ।
২. উৎসগত পার্থক্য :
মুনাফার উৎস দ্রব্য ও সেবার ক্রয়-বিক্রয় থেকে কিন্তু সুদের মূল উৎস হলো ঋণ ।
৩. শ্রম বিনিয়োগের ক্ষেত্রে :
মুনাফা অর্জনে বিনিয়োগকারীকে শ্রম, পুঁজি ও সময় দিতে হয়। কিন্তু সুদ অর্জনের জন্য ঋণদাতাকে কোনো প্রকার শ্রম ও সময় দিতে হয় না। তাই বলা হয়ে থাকে সুদ হলো অলস তহবিলের ফসল ।
৪. আয় বৈষম্য :
সমাজের অল্প পুঁজি বা দরিদ্র শ্রেণির মানুষকে শোষণের মাধ্যমে সুদ আদায় করা হয় বিধায় সমাজে আয় বৈষম্য সৃষ্টি হয়, কিন্তু বৈধ মুনাফার মাধ্যমে সমাজে আয় বৈষম্য সৃষ্টি হয় না ।
৫. নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি :
বিভিন্ন প্রতিকূল ও ঝুঁকি মোকাবিলা বিনিয়োগকারী যখন মুনাফা হাতে পায় তখন তার মনপ্রাণ করে খুশিতে ভরে ওঠে। এতে আত্মতৃপ্তিও থাকে। কিন্তু অনৈতিক উপায়ে অর্জিত সুদে রয়েছে একশ্রেণির অসাধু লোকের নীতি বিবর্জিত আয় প্রক্রিয়া। এ আয়কে নিষিদ্ধ করে মহান আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহ ব্যবসায়কে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম।”
৬. পূর্বনির্ধারণী :
মুনাফা হলো ক্রয়-বিক্রয়ের হিসাবকৃত লভ্যাংশ যা অবশ্যই পরে নির্ধারিত হয় কিন্তু সুদ পূর্বনির্ধারিত হারে আদায় করা হয় ।
৭. ঝুঁকিগত পার্থক্য :
মুনাফা অর্জনের জন্য বিনিয়োগকারীকে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হয় এমনকি ক্ষতিও স্বীকার করতে হতে পারে। কিন্তু সুদের ক্ষেত্রে ঋণদাতার কোনো ঝুঁকি নেই ৷
৮. উপাদানগত পার্থক্য :
সুদকে প্রবাহ (Flow) উপাদান বলা হয়, কেননা সুদ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে পারে। আর মুনাফা হলো Stock উপাদান ।
উপর্যুক্ত
আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সুন্দ শোষণ ও জুলুমের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি
অন্যায় ও অমানবিক ব্যবস্থা আর মুনাফা পণ্য ও সেবা ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়ায়
পুঁজির বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অংশ । তাই বলা যায় সুদ এবং মুনাফা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি
বস্তু। সুদের উৎস হচ্ছে ঋঋণ প্রদান যাতে দাতার কোনো পরিশ্রম, সময় ব্যয় হয় না
এবং কোনো ঝুঁকিও থাকে না । আর মুনাফার উৎস হচ্ছে পুঁজি ও শ্রম বিনিয়োগের ফসল
যেখানে বিনিয়োগকারীকে প্রয়োজনে ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হয়। অর্থনীতিতে সুদ ও
মুনাফা এ দুটো ধারণাতেই মৌলিক পার্থক্য লক্ষ করা যায় ।
সুদ ও মুনাফার বৈশিষ্ট্য : নিম্নে সুদ ও মুনাফার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো :
১. সুদের বৈশিষ্ট্য :
সুদের
কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা তাকে মুনাফা থেকে পরিষ্কারভাবে পৃথক করেছে।
নিম্নে সেই বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করা হলো :
ক. ঋণের সাথে সম্পৃক্ত : সুদের বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সুদ অবশ্যই
ঋণের সাথে সম্পৃক্ত হবে। সেটা অর্থ, দ্রব্যসামগ্রী বা সেবা হতে পারে।
খ. পূর্বনির্ধারিত : সুদ সময়ের সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ সুদের পরিমাণ বা প্রদেয় সময়সহ
আনুষঙ্গিক সবকিছু পূর্বেই নির্ধারিত হয় ।
গ. শ্রমহীন উপার্জন : সুদ শ্রম ছাড়াই উপার্জন
করা যায় অর্থাৎ সুদের আয় অলস প্রকৃতির ।
ঘ. ঝুঁকিমুক্ত : সুদ সবসময় ঝুঁকিমুক্ত থাকে। তাই ঋণদাতার কোনো ঝুঁকি বা
অনিশ্চয়তা থাকে না ।
ঙ. অর্থনৈতিক বৈষম্য : সুদ সমাজে অর্থনৈতিক
বৈষম্য সৃষ্টি করে ।
চ. চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি : সুদ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে ।
ছ. অঋণাত্মক : সুদ কখনোই ঋণাত্মক হয় না ।
২. মুনাফার বৈশিষ্ট্য :
মুনাফার
কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা তাকে সুদ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক রেখেছেন। উক্ত
বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হলো :
ক. অনির্ধারিত আয় : মুনাফার আয় নির্ধারিত নয়; বরং এটি অনির্ধারিত আয়। কারণ মুনাফার
পরিমাণ আগে থেকে নির্ধারণ করা যায় না।
খ. শ্রম ও পুঁজিভিত্তিক ফল : মুনাফা বিনিয়োগকারীর শ্রম, সময় এবং বিনিয়োগের পরিমাণের ওপর
নির্ভর করে মুনাফার পরিমাণ। তাই মুনাফা হলো শ্রম ও পুঁজিভিত্তিক ফল ।
গ. মুনাফার অবস্থা : মুনাফা ধনাত্মক, শূন্য এমনকি ঋণাত্মকও হতে পারে।
ঘ. ঝুঁকি বহন করতে হয় : মুনাফা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাকে বিভিন্ন ধরনের অনিশ্চয়তা
ও ঝুঁকি বহন করতে হয়। তাই এটি একটি অনিশ্চিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ আয় ।
ঙ. চক্রবৃদ্ধি : মুনাফার ক্ষেত্রে চক্রবৃদ্ধি হারের কোনো ভূমিকা নেই ।
চ. বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা : মুনাফাভিত্তিক অর্থব্যবস্থায় ক্রেতা ও বিক্রেতাসহ উৎপাদনে
নিয়োজিত এবং সংশ্লিষ্ট সকলেই একটি বৈষম্যহীন নীতির আলোকে পরিচালিত হয় বলে সমাজে
অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকে না ।
উপসংহার :
উপর্যুক্ত
আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মহান আল্লাহ তায়ালা সুদ ও সুদভিত্তিক সকল
কর্মকাণ্ডকে চিরতরে হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কারণ মানব সভ্যতা ধ্বংসের
অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে সুদ। অপরপক্ষে ক্রয়- বিক্রয় ও বাণিজ্য থেকে মূলধনের যে
অতিরিক্ত অংশ অর্জিত হয় তাই মুনাফা । এটি ঝুঁকিভিত্তিক ব্যবসায়িক লভ্যাংশ, যা
ইসলামে পরিপূর্ণভাবে বৈধ। সুদ এবং মুনাফার মধ্যে কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে
যা তাদেরকে পরিষ্কারভাবে পৃথক করতে পারে।