আলীগড় আন্দোলন কি? আলীগড় আন্দোলনের উদ্দেশ্যসমূহ ও অবদান আলোচনা কর ।

 

আলীগড় আন্দোলন কি? আলীগড় আন্দোলনের উদ্দেশ্যসমূহ ও অবদান আলোচনা কর ।


আলীগড় আন্দোলন কি?  আলীগড় আন্দোলনের উদ্দেশ্যসমূহ ও অবদান আলোচনা কর 


ভূমিকা : 

ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজসংস্কারে যেসব গুণী ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন তাদের মধ্যে স্যার সৈয়দ আহমদ খান অন্যতম। তার সংস্কারমূলক কাজের মধ্যে আলীগড় আন্দোলন উল্লেখযোগ্য ।এ আন্দোলন ছিল মুসলিম জনসমাজকে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় উপযোগী করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা। মুসলমানদের আধুনিক ও সময় উপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আলীগড় আন্দোলন গড়ে ওঠে ।

আলীগড় আন্দোলনের উদ্দেশ্যসমূহ : 


স্যার সৈয়দ আহমদ খান ছিলেন আলীগড় আন্দোলনের প্রবক্তা। এ আন্দোলনের জন্য তিনি আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি কতকগুলো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এ আন্দোলন গড়ে তোলেন। নিম্নে আলীগড় আন্দোলনের উদ্দেশ্যসমূহ উল্লেখ করা হলো- 

১. আলীগড় আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের মধ্য থেকে বিভিন্ন অজ্ঞতা ও কুসংস্কার দূর করা। কেননা তৎকালীন মুসলমানরা ইংরেজ বিদ্বেষী হয়ে আধুনিক সংস্কৃতিকে মেনে নেয়নি। যার কারণে মুসলিম সমাজ পিছিয়ে পরে।

২. আলীগড় আন্দোলনের আরও একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদেরকে সমকালীন শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। আর এজন্য তিনি ১৮৬৩ সালে সাহিত্য ও বিজ্ঞান সমিতি নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন এবং মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন।

৩. তৎকালীন মুসলমানগণ পির পূজার প্রচলন করেছিল। স্যার সৈয়দ আহমদ খান আলীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে পির মুরিদ ও দাস প্রথার উচ্ছেদের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজকে আধুনিক ধ্যান ধারণায় উদ্বুদ্ধ করনের প্রচেষ্টা চালান।

৪. আলীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানদের সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইংরেজি প্রভৃতি শিক্ষার প্রতি যে বিমুখতা ছিল তা অবসান ঘটানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। যাতে করে মুসলমানগণ এসব শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে চাকরিসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা গ্রহণে সক্ষম হয়। তাই এ আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল তাদের অধিকার ও সুযোগ আদায়ে সক্ষম করে তোলা ।

৫. মুসলমানদের মধ্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করা ছিল আলীগড় আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এজন্য স্যার সৈয়দ আহমদ খান তাহযিব উল আখলাক' নামে পত্রিকা- প্রকাশ, ১৮৮৬ মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন, মুসলিম শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি গঠন প্রভৃতি কর্ম প্রক্রিয়া গ্রহণ করেন । 

অতএব বলা যায় যে, আলীগড় আন্দোলন মুসলিম জাতীয়তার অবতারণা, অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনে মুসলিম সমাজকে সচেতন ও জাগ্রত করে। এ আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলিম সমাজ আধুনিক (তৎকালীন) জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় শামিল হয়, শিক্ষা দীক্ষায় নিজেদের সমৃদ্ধ করে এবং অধিকারবোধ জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে জাগরণ সৃষ্টি করে । 


অবিভক্ত ভারতে আলীগড় আন্দোলনের অবদানঃ 


আলীগড় আন্দোলন ভারতীয় উপমহাদেশের নির্যাতিত মুসলমানদের জন্য একটি ব্যাপক কার্যকর সংস্কারমূলক আন্দোলন। ব্রিটিশ ভারতে যেসব আন্দোলন সমাজসেবার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে তার মধ্যে আলীগড় আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। আলীগড় আন্দোলনের সূচনা করেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান। তিনি মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে কুসংস্কারমুক্ত করার মানসে আলীগড় স্যার সৈয়দ আহমদ খান আন্দোলন গড়ে তোলেন।  মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষার বিস্তার, সমাজসংস্কার এবং কুসংস্কার দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

অবিভক্ত ভারতে মুসলিম জাগরণে আলীগড় আন্দোলনের অবদান:

নিম্নে অবিভক্ত ভারতে মুসলিম জাগরণে আলীগড় আন্দোলনের  অবদান আলোচনা করা হলো-

১. বিজ্ঞান সমিতি প্রতিষ্ঠা : 

১৮৬৩ সালে সৈয়দ আহমদ খান একটি অনুবাদ সমিতি প্রতিষ্ঠা করে ইতিহাস, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের মূল্যবান গ্রন্থাবলি মুসলমানদের শিক্ষার স্বার্থে অনুবাদের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে এটি সাহিত্য ও বিজ্ঞান সমিতি' নামে পরিচিত লাভ করে। সাহিত্য ও বিজ্ঞান সমিতি ইংরেজ ও মুসলমানদের অবসান, পারস্পরিক আন্তরিকতা বৃদ্ধি ও মুসলমানদের জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র প্রসারিত করে। কুসংস্কারে নিমজ্জিত মুসলমানদের আত্মসচেতনতা ফিরিয়ে আনতে এ সমিতি যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।

২. দাসত্ব ও পির প্রথার বিরোধিতা: 

আলীগড় আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল পির মুরিদ ও দাসপ্রথার উচ্ছেদের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজকে আধুনিক ধ্যানধারণায় উদ্বুদ্ধ করা। স্যার সৈয়দ আহমদ খান এসব প্রথার বিরুদ্ধে; জনগণকে সচেতন করে তোলেন।

৩. মুসলমানদের পৃথক স্বাধীন সত্তা : 

আলীগড় আন্দোলনই  ভারতবর্ষে মুসলিম জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটায় এবং স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণে মুসলমানদের অনুপ্রেরণা প্রদান করে। এভাবে এ আন্দোলনই এতদঞ্চলে মুসলমানদের পৃথক ও একক স্বাধীন সত্তা লাভের পটভূমি রচনা করেছিল।

৪. সমাজসংস্কার :

সমাজসংস্কারে আলীগড় আন্দোলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। এ আন্দোলনের প্রভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে থেকে সামাজিক কুসংস্কার ও • ধর্মীয় গোঁড়ামি দূরীভূত হয়ে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন ঘটে। তিনি নারীশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় অনেক লেখালেখি করেন। ফলে নারীরা গৃহবন্দি জীবন থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পায়।

৫. মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি গঠন : 

আলীগড় আন্দোলনের অনুকরণেই অবিভক্ত বাংলার মুসলমানদের কল্যাণ নওয়াব আবদুল লতিফ ১৮৬৩ সালে 'মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি  গঠন করেন। এটি ভারতবর্ষে সংস্কার আন্দোলনের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ।

৬. পত্রিকা প্রকাশ : 

আলীগড় আন্দোলনের প্রবক্তা স্যার সৈয়দ | উপসং আহমদ খান কুসংস্কারে নিমজ্জিত সুমলমানদের অবনতির কারণ বিশদভাবে ব্যাখ্যা এবং তাদেরকে কুসংস্কারের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য 'তাহযিব উল আখলাক' নামে একটি সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এতে মুসলমানগণ তাদের অজ্ঞতা কুসংস্কারাচ্ছন্নতা সম্পর্কে সচেতন হয় এবং তা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খোঁজে।

৭. মুসলিম শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি গঠন : 

আলীগড় আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে মুসলিম, শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি গঠন করা হয়। এ সমিতির মাধ্যমেই ১৮৭৫ সালের মে মাসে 'মোহামেডান এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ' স্থাপিত হয়। ১৮৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে আলীগড় কলেজের ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং ১৯২০ সালে তা 'আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়' এ উন্নীত হয়। পরবর্তীতে একটি 'আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়' নামে পরিচিত লাভ করে। 

৮. মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন : 

আলীগড় আন্দোলনের অংশ হিসেবে মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইংরেজি শিক্ষা সম্পর্কে গোঁড়া মুসলমানদের বিদ্বেষ ভাব দূর করার লক্ষ্যে ১৮৮৬ সালে মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ছাড়াও 'মাদরাসাতুল উলুম' এবং উত্তর-পূর্বঞ্চলীয় জেলাগুলোর জন্য ‘শিক্ষা কমিটি' মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা চেতনা বিকাশে বিশেষ অবদান রাখে ।

৯. মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব : 

আলীগড় আন্দোলনের ফলে মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এ আন্দোলনের ফলেই মুসলিম সমাজ ক্রমশ ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়। আলীগড় আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজের উদ্ভব হয় পরবর্তীকালে তারাই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় । 

১০. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা : 

আলীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের ওপর অত্যধিক গুরুত্বরোপ করা হয় । ইংরেজি শিক্ষা ব্যতীত মুসলমানদের উন্নতি সম্ভব নয় ভেবেই বিভিন্ন স্থানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়া এ সময় বিখ্যাত ইংরেজি গ্রন্থসমূহ ফারসি ভাষায় অনুদিত হয়। এতে করে মুসলমানগণ শিক্ষাদীক্ষায় নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করতে পারে । 

১১. রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি :

সমাজসংস্কার স্যার সৈয়দ আহমদ খান আলীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করেন। কোনো জাতি যদি রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সচেতন না হয় তাহলে তারা নানানভাবে অধিকার বঞ্চিত হয়। এ অধীকারবোধ জাগিয়ে তুলতে তিনি মুসলমানদের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করেন ।

১২. মুসলমানদের মধ্যে নবজাগরণ : 

আলীগড় আন্দোলন মুসলমানদের মধ্যে নবজাগরণের সৃষ্টি করে। আলীগড় আন্দোলনের অনুকরণে অনেকেই এ সময় সমাজে নবজাগরণে সচেষ্ট হন। এদের মধ্যে নওয়াব আবদুল লতিফের মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি, সৈয়দ আমির আলির সেন্ট্রাল মোহামেডান এসোসিয়েশন এবং দেওবন্দে দারুল উলুম অন্যতম ।

উপসংহার : 

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আলীগড় আন্দোলনই মুসলিম জাতীয়তার অবতারণা করে স্বাধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম মুসলমানদের জাগ্রত করে। আলীগড় আন্দোলন মুসলমানদের পৃথক ও একক স্থানীয় স্বাধীন সত্তা লাভের পটভূমি রচনা করেছিল। এ আন্দোলনই মুসলিম সমাজে প্রথম প্রগতিবাদী শিক্ষামূলক সংস্কার সাধন করে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার মুসলমানদের শামিল করে। ফলে মুসলমানগণ শিক্ষাদীক্ষায় নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করে এবং এ আন্দোলনের ফলে নিজেদের সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হয় ।


Post a Comment

Previous Post Next Post