ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি সংক্রান্ত আজকের
আর্টিকেলে আপনাদেরকে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি সংক্রান্ত সকল বিষয়ের উত্তর জানাব। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার
সময় আমরা ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সংজ্ঞা, ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সুবিধা অসুবিধা, ভার্চুয়াল
রিয়েলিটির উপাদান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কিঃ
তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ অন্য এক নতুন পৃথিবীর সন্ধান পেয়েছে। এ পৃথিবী হচ্ছে অনুভবের পৃথিবী যা বাস্তব নয়; তবে বাস্তবতার বিভ্রম সৃষ্টিকারী প্রযুক্তি নির্ভর কল্পনা। এ কল্পনাই হলো ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বা অনুভবে বাস্তবতা।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি একটি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ যেখানে ব্যবহারকারী ঐ পরিবেশে নিমজ্জিত হয়ে বাস্তবের অনুকরণে তৈরি দৃশ্য উপভোগ করতে পারে এবং একই সাথে বাস্তবের ন্যায় শ্রবণাভূতি, দৈহিক ও মানসিক ভাবাবেগ, কল্পনার অনুভূতি ইত্যাদি অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে।
প্রকৃত অর্থে বাস্তব নয় কিন্তু বাস্তবের চেতনা বহনকারী প্রযুক্তি নির্ভর কল্পনাকে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বা কল্পবাস্তবতা বলে। ১৯৬১ সালে মর্টন এল হেলিগ-এর তৈরি সেরামা সিমুলেটর নামক যন্ত্রের মাধ্যমে প্রথম ভার্চুয়াল রিয়েলিটির আত্মপ্রকাশ ঘটে।
এটি অনেকটা ভিডিও গেমসের মতো, যেখানে মূল প্রোগ্রামের মধ্যে থেকেই নিজস্ব কল্পনার প্রয়োগ ঘটানো সম্ভব। তথ্য আদান-প্রদানকারী বিভিন্ন ডিভাইস সংবলিত চশমা, headsets, gloves, suit এবং ত্রিমাত্রিক স্ক্রিন সংবলিত একটি হেলমেট পরে বাস্তব থেকে অনুকরণকৃত অ্যানিমেটেড বা প্রাণবন্ত ছবি দেখা যায়।
ইচ্ছে করলে চাঁদের মাটিতে হেঁটে আসা, প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে ভ্রমণ করা, সমুদ্র সৈকতে ভ্রমণ, অতিকায় ডাইনোসর দেখা ও ডাইনোসরের তাড়া খাওয়া, মানুষের মস্তিষ্কের নিউরাল সংযোগের উপর দিয়ে হাঁটাও সম্ভব।
বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কাজে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন— সৈনিককে যুদ্ধের পরিবেশে আসল বন্দুক এবং মৃত্যুর ঝুঁকিতে না ফেলে প্রশিক্ষণ দেওয়া, নতুন ড্রাইভারকে রাস্তায় ছেড়ে না দিয়ে ভার্চুয়াল রাস্তায় গাড়ি চালাতে দিয়ে আসল রাস্তায় চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব।
গুগল সম্প্রতি
Lively নামে একটি ভার্চুয়াল চ্যাটিং সার্ভিস চালু করেছে যেখানে একটি ভার্চুয়াল পরিবেশে
যে কেউ তার বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে প্রবেশ করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে
পারে।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির জনক বলা হয় জেরন ল্যানিয়ারকে (Jaron Lanier)। জেরন ল্যানিয়ার ছাড়াও আরও অনেকে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি নিয়ে কাজ করেছে। তবে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির একক জনক হিসেবে জেরন ল্যানিয়ারকেই ধরা হয়।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির উপাদান গুলো কি কি
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির উপাদান গুলো কি কি এই বিষয় নিয়ে নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ
১. ইফেক্টর (Effector) :
ইফেক্টর হলো বিশেষ ধরনের ইন্টারফেস ডিভাইস যা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি পরিবেশের সাথে সংযোগ সাধন করে। যেমন— মাথায় বসানো ডিসপ্লে (Head Mounted Display HMD), গ্লোভ (gloves), পোষাক (suit) ইত্যাদি।
২.রিয়েলিটি সিমুলেটর (Reality Simulator) :
রিয়েলিটি সিমুলেটর হলো এক ধরনের হার্ডওয়্যার যা ইফেক্টরকে সংবেদনশীল (চাক্ষুস বা শ্ৰুতিবোধসম্পন্ন) তথ্য সরবরাহ করে। যেমন— বিভিন্ন ধরনের সেন্সর, অডিও বা ভিডিও প্রসেসিং ডিভাইস, চাপ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন ধরনের ট্রান্সডিউসার ইত্যাদি।
৩. অ্যাপ্লিকেশন (Application) :
অ্যাপ্লিকেশন হলো এক ধরনের সফটওয়্যার যা সিমুলেশনের প্রাসঙ্গিকতা বর্ণনা করে। অপারেটিং সিস্টেমের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধরনের অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার দেখা যায়। যেমন— ইন্টেল প্রসেসর নির্ভর পিপির জন্য অটোডেস্কের "Division"।
৪. জিওমেট্রি (Geometry) :
জিওমেট্রি হলো ভার্চুয়াল পরিবেশের বিভিন্ন বস্তুর বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য
সম্পর্কিত তথ্যাবলি। মূলত কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন বা ক্যাড সফটওয়্যার দিয়ে জিওমেট্রি
তৈরি করা হয়। যেমন— ইন্টেল প্রসেসর নির্ভর পিসিতে বিভিন্ন বস্তুর ৩ডি মডেলিং করার জন্য
অটোডেস্কের "AutoCAD" সফটওয়্যার। ক্যাড সফটওয়্যার দ্বারা তৈরি করা ফাইল
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির রেন্ডারিং এবং অর্থরিং করার জন্য এক্সপার্ট করা হয়।
প্রাত্যহিক জীবনে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির প্রভাব:
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বর্তমানে সমাজের সর্বস্তরে ব্যবহার না হলেও প্রাত্যহিক জীবনে এর প্রভাব রয়েছে। বিভিন্ন পেশা ও গবেষণায় ভার্চুয়াল রিয়েলিটির প্রয়োগের ফলে সমাজে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। নিচে তা আলোচনা করা হলো :
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সুবিধাঃ
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সুবিধা নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ
১। সামরিক ক্ষেত্রে :
সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীসহ বিভিন্ন প্রকার প্রশিক্ষণের জন্য ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করা হয়। ফ্লাইট সিমুলেটরের সাহায্যে আসল বিমান চালানোর আগে প্রশিক্ষণের এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে বিমান চালানোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করে সিমুলেটেড ওয়ার, যানবাহন সিমুলেশন-এর মাধ্যমে সৈন্যদের অনেক বেশি বাস্তব ও উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়।
২। চিকিৎসা ক্ষেত্রে :
আজকাল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ডাক্তারদের উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করা হয়। সার্জিক্যাল প্রশিক্ষণ যেমন— ‘এম আইএসটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ল্যাপরোস্কোপিক' প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে ল্যাপরোস্কোপিক পরিচালনার বিভিন্ন কৌশল শিখানো হয়। তাছাড়া নার্সিং শিক্ষায়, থেরাপি প্রশিক্ষণে, বিভিন্ন মানসিক রোগের লক্ষণ নির্ণয়ে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করা হয়।
৩। শিক্ষাক্ষেত্রে :
শিক্ষার পরিবেশ এবং শেখানোর কৌশল আয়ত্তে নেওয়ার জন্য ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করা হয়।
৪। বিনোদন ও ফ্যাশনের ক্ষেত্রে :
বিনোদনে ভার্চুয়াল থিম পার্কে সিমুলেশন ব্যবহার করা হয়। যেমন— ভিডিও গেমস-এর মতো মূল প্রোগ্রামের মধ্যে থেকেই নিজস্ব কল্পনার প্রয়োগ ঘটানো সম্ভব। পোশাকের ডিজাইন, ভার্চুয়াল ফেশন শো'র মাধ্যমে পরাবাস্তব পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়।
৫। ঐতিহ্য প্রদর্শনে :
ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু বা স্থান প্রদর্শনের জন্য ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে সিমুলেশন ব্যবহার করে ঐতিহাসিক আবহ তৈরি করা হয়। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সুবিধা হলো বাস্তব ঘটনার মুখোমুখি না হয়েও একজন মানুষ প্রায় বাস্তব অবস্থার জ্ঞান অর্জন করতে পারে।
৬। ব্যবসায়-বাণিজ্যে ও মহাকাশ অভিযানে :
ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে ক্রেতার সন্তুষ্টি সৃষ্টি, বিক্রয় বৃদ্ধি ও দ্রব্যের গুণগত মান সম্পর্কিত বিষয়ে সেমিনারের আয়োজন করতে পারেন। মহাকাশ অভিযানে নভোচারীদের কার্যক্রম ও নভোযান পরিচালনা সম্পর্কিত বিষয় এবং কোনো যন্ত্র অকেজো হলে তাকে কার্যক্ষমসহ নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মহাকাশে তাদের ভ্রমণ অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত, নিরাপদ ও আনন্দময় হয়ে ওঠে।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির অসুবিধাঃ
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির অসুবিধা নিম্নে
আলোচনা করা হলোঃ
১। কল্পনার রাজ্যে বিচরণ :
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে মানুষ তার কল্পনার রাজ্যে ইচ্ছেমতো বিচরণ করতে পারবে। ফলে দেখা যাবে মানুষ বেশিরভাগ সময় কাটাবে কল্পনার জগতে এবং খুব কম সময় থাকবে বাস্তব জগতে। একসময় হয়তো মানুষ কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে কোনো পার্থক্য করতে পারবে না। কিন্তু এভাবে যদি মানুষ কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য করতে না পারে তাহলে এই পৃথিবী চরম অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হবে।
২। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতি :
গবেষণায় দেখা গেছে যে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর। এটি মানুষের দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তির ক্ষতিসাধন করে।
৩। মনুষ্যত্বহীনতা :
বর্তমান সমাজের মনুষ্যত্বহীনতা ব্যাপারটি হচ্ছে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির অন্যতম নেতিবাচক
দিক। পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে মনুষ্যত্বকে ধরে রাখতে হবে এবং একই
সাথে খেয়াল রাখতে হবে যেন আমরা প্রযুক্তি দ্বারা চালিত না হয়ে প্রযুক্তিকে চালনা
করতে পারি।
যদি বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে তাহলে মানুষের পারস্পরিক ক্রিয়া উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে। কারণ মানুষ তখন ভার্চুয়াল রিয়েলিটি দ্বারা বাস্তব জীবনের চেয়েও অনেক ভালো সঙ্গী এবং মনের মতো পরিবেশ পাবে।
আর মানুষ যদি এভাবে
Boggles আর gloves-কে মানুষ ও সমাজের বিকল্প হিসেবে বেছে নেয় তাহলে মানবসমাজ বিলুপ্ত
হতে আর বেশি সময় লাগবে না।
আশা করি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি শীর্ষক
আজকের আর্টিকেলটি আপনাদের মনের ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি সংক্রান্ত সকল প্রশ্নের উত্তর
দিয়ে দিয়েছে। নতুন নতুন বিষয় জানতে আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন। ধন্যবাদ।