কল্যাণরাষ্ট্র কী? কল্যাণরাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।
ভূমিকা :
রাষ্ট্র হচ্ছে একটি জনকল্যাণমূলক ধারণা। কল্যাণরাষ্ট্র প্রত্যয়টি একটি বিশেষ ধরনের সরকার ব্যবস্থাকে বুঝায়। যেখানে নাগরিকদের অর্থনৈতিক কল্যাণ, সামাজিক উন্নয়ন ও সংরক্ষণের কাজে রাষ্ট্র বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কল্যাণরাষ্ট্রে জনগণের সামগ্রিক কল্যাণে আত্মনিয়োগ করা হয়ে থাকে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র একদিকে অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রেখে বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করে, অন্যদিকে ব্যক্তির সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহের সমাধান করে এবং ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথ সুগম করে থাকে ।
কল্যাণরাষ্ট্র :
সাধারণ অর্থে, যে রাষ্ট্রে সরকার ও নাগরিকদের যৌথ উদ্যোগে মানুষ সুখেশান্তিতে বাস করে তাকে কল্যাণরাষ্ট্র বলে। অন্যভাবে বলা যায়, কল্যাণরাষ্ট্রে মূলত নাগরিকদের আর্থসামাজিক, মৌল মানবিক, মনোদৈহিকসহ সব ধরনের নিশ্চয়তামূলক কার্যাবলি পরিচালনায় সহায়তা করে থাকে ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা :
প্রখ্যাত দার্শনিক Ebenstein এর মতে, “যে রাষ্ট্র প্রতিটি ব্যক্তির জীবনমান ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে স্থায়িত্ব ও উন্নতি বিধান করে এবং পূর্ণ নিয়োগে সহায়তা করে তাকে বলা হয় জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র।”
অধ্যাপক বেনথাম (Prof. Bentham) কল্যাণরাষ্ট্রের সংজ্ঞায় বলেন, “যে রাষ্ট্রে জনগণের সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তাকে কল্যাণরাষ্ট্র বলে।”
জাতিসংঘ (UNO) এর মতে, “যেসব রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিকদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান করে এবং অর্জনে ব্যর্থ হলে জনগণের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করে তাকে কল্যাণরাষ্ট্র বলে।
কল্যাণরাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য :
কল্যাণরাষ্ট্র রাষ্ট্রের সকল জনগণের কল্যাণসাধনে রত থাকে। তাই কল্যাণরাষ্ট্রে জনগণের কল্যাণের ক্ষেত্রে কল্যাণমূলক কমসূচির ব্যাপক বাস্তবায়ন ও গ্রহণ করা হয়। কল্যাণ ও রাষ্ট্র এ দুটি শব্দের মাধ্যমে কল্যাণরাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিম্নে কল্যাণরাষ্ট্রের আলোচনা করা হলো-
১. মৌলিক চাহিদা পূরণ :
প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য হচ্ছে মৌলিক চাহিদা পূরণ করা। আর এসব চাহিদা পূরণে সচেষ্ট হয় কল্যাণরাষ্ট্রসমূহ যা একটি মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।
২. সাম্য ও ন্যায়বিচার :
কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। কিছু কল্যাণরাষ্ট্র সবার প্রতি সমান শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করে এবং প্রত্যেক নাগরিকের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে।
৩. নাগরিক অধিকার :
নাগরিকদের অধিকার রক্ষা প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব । তাই কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নাগরিক অধিকার রক্ষা করা। অধিকার প্রদান মানুষকে স্বাভাবিক জীবনদানে সক্ষমতা অর্জন করে থাকে। যা কেবলমাত্র কল্যাণরাষ্ট্রই তার বন্দোবস্ত করে থাকে। এ প্রসঙ্গে T.H. Green বলেন, “সব অধিকার রক্ষার মাধ্যমে রাষ্ট্র নাগরিকদের কল্যাণে দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর।
৪. সামাজিক নিরাপত্তা :
সামাজিক নিরাপত্তা কল্যাণরাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কল্যাণরাষ্ট্র নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তার বিধান করে থাকে। প্রতিকূল যেকোনো সমস্যার ক্ষেত্রে জনগণের পাশে এসে দাঁড়ায় কল্যাণরাষ্ট্র। তাছাড়া রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে দারিদ্র্য, ক্ষুধা, বিশৃঙ্খলা প্রভৃতি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ।
৫. উত্তম শাসনব্যবস্থা :
উত্তম শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে কল্যাণরাষ্ট্রের ভূমিকাই মুখ্য । কেননা কল্যাণরাষ্ট্র ব্যবস্থাকে একটি উত্তম রাষ্ট্র ব্যবস্থা বলা যায়। জনগণের সব মৌল মানবিক চাহিদাসহ যেকোনো চাহিদা পূরণে কল্যাণরাষ্ট্র নিশ্চিত করে থাকে যা উত্তম শাসনব্যবস্থার একটি অংশ। তাই কল্যাণরাষ্ট্রে উত্তম শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয় ।
৬. ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা :
প্রতিটি ব্যক্তির নিজস্ব স্বাধীনতা রয়েছে। কল্যাণরাষ্ট্র সেক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তাই ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণ করা কল্যাণরাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত।
৭. কর্মসংস্থানের সৃষ্টি :
কর্মসংস্থান ব্যক্তির জীবিকানির্বাহের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা কল্যাণরাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই এ লক্ষ্যে কল্যাণরাষ্ট্রে পূর্ণ নিয়োগের নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। তাছাড়া যে ব্যক্তি যে কাজের জন্য দক্ষ তাকে সে কাজের ক্ষেত্রে নির্ধারণ করা হয়।
৮. পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন :
যেকোনো সুষ্ঠু কাজের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন দরকার হয় । তাই কল্যাণরাষ্ট্রের অন্যতম বেশিষ্ট্য হলো পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা । অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও নাগরিকদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কল্যাণরাষ্ট্র এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে ।
৯. স্বাধীন সমাজব্যবস্থা :
রাষ্ট্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বাধীন সামজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। সেক্ষেত্রে কল্যাণরাষ্ট্রগুলো স্বাধীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় কাজ করে থাকে। আর এর মাধ্যমে ব্যক্তির নিজস্ব বিকাশ ত্বরান্বিত হয় এবং সমাজের সব নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করে ।
১০. শিক্ষার প্রসার :
প্রত্যেক রাষ্ট্রই শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। কেননা শিক্ষাই হলো জাতির মেরুদণ্ড। তাই শিক্ষাকে কেন্দ্র করে সমাজে আলো ছড়ায় এবং কুসংস্কার দূর হয়। যে রাষ্ট্রে যত শিক্ষার হার বেশি সে রাষ্ট্র তত বেশি কল্যাণ বয়ে আনে ।
১১. নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন :
নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন কল্যাণরাষ্ট্রের নাগরিকদের একটি পরিচিত বৈশিষ্ট্য। সেক্ষেত্রে কল্যাণরাষ্ট্র নাগরিকদের নৈতিক চরিত্র উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। কল্যাণরাষ্ট্র নাগরিকদের চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তুলতে চায় আর এ লক্ষ্যে রাষ্ট্র কাজ করে থাকে ।
১২. সর্বজনীন ও সামগ্রিক কল্যাণ :
কল্যাণরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো সমাজের সব নাগরিকদের সর্বজনীন ও সামগ্রিক কল্যাণসাধন করা। তাই কল্যাণরাষ্ট্র এ লক্ষ্যে সমানভাবে কাজ করে থাকে ।
উপসংহার :
উপর্যুক্ত
আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কল্যাণরাষ্ট্র হচ্ছে সেই রাষ্ট্র যেখানে সরকার
ও জনগণের যৌথ উদ্যোগে মানুষ সুখেশান্তিতে বসবাস করে। উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্য ব্যতীত কল্যাণরাষ্ট্রের আরও
বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, আয় বৃদ্ধি, বৈষম্য হ্রাস,
জাতীয় আয় বৃদ্ধি, সন্তোষজনক জীবনযাপন, সম্পদের সুসম বণ্টন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। যা কল্যাণরাষ্ট্রের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে এবং
কল্যাণরাষ্ট্রসমূহ তাদের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য পালন করার মধ্যে যথাযথ অবদান রাখতে
সচেষ্ট হয়।