সমাজসংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান বর্ণনা কর

 সমাজসংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান বর্ণনা কর

 সমাজসংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান বর্ণনা কর ।


ভূমিকা : 


ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজসংস্কারক হিসেবে যে কয়েকজন মনীষীর নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে তাদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অন্যতম। রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর সমাজসংস্কার আন্দোলনে ভাটা পড়ে এবং উপমহাদেশের জনগোষ্ঠী আবার শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে পড়ে কুসংস্কারাচ্ছন্নতায় জড়িয়ে পড়ে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হিন্দু বিধবাবিবাহের প্রচলন, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রোধ এবং শিক্ষাবিস্তারের মাধ্যমে সমাজসংস্কারে অসামান্য অবদান রেখেছেন।


সমাজসংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান : 


হিন্দু বিধবাবিবাহের প্রচলন, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন, বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রামসহ সমাজসংস্কারের নানা ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান অসীম। তিনি তাঁর জীবনকে সমাজসংস্কারমূলক কাজে উৎসর্গ করেছিলেন। নিম্নে সমাজসংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা আলোচনা করা হলো-


১. হিন্দু বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়ন : 


হিন্দু বিধবাবিবাহের প্রচলন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সবচেয়ে বড় সমাজসংস্কার। রাজা রামমোহন রায়ের যুগান্তকারী সংস্কার সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ হলে সমাজে বিধবাদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। সে সময়ে অনেক কুলীন ব্রাহ্মণ একাধিক বিবাহ করতেন এবং তাদের স্ত্রীরা তাদের মৃত্যুর পর মানবেতর জীবনযাপন করতো। তখনকার হিন্দুসমাজে বিধবাদের দ্বিতীয়বার বিবাহ করার কোনো সুযোগ ছিল না। পুনঃবিবাহের সুযোগ না থাকায় এসব অকাল বিধবাদের দ্বারা সংঘটিত পাপাচারের সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পায়।


এরই প্রেক্ষিতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হিন্দু বিধবাবিবাহ আন্দোলন শুরু করেন। বিধবাবিবাহের পক্ষে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি ১৮৫৫ সালে তার 'তত্ত্ববোধন' পত্রিকায় লেখনীর মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে তোলেন। তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে জনগণকে একথা বুঝাতে সমর্থ হন যে, হিন্দু বিধবাবিবাহ কোনো শাস্ত্রবিরোধী কাজ নয় এবং এটি হবে সমাজের জন্য মঙ্গলজনক।


পরবর্তীতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হিন্দু বিধবাবিবাহ প্রচলনে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ৯৮৭ জনের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদনপত্র ব্রিটিশ সরকারের নিকট পেশ করেন। এ আবেদনপত্রে বলা হয়, দেশাচার অনুসারে সমাজে হিন্দু বিধবাদের পুনঃবিবাহ নিষিদ্ধ । কিন্তু এ নিষেধ শাস্ত্র সম্মত নয়। এভাবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই হিন্দু বিধবাবিবাহ আইন পাস হয় ।

২. বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন : 


তৎকালীন হিন্দুসমাজে বাল্যবিবাহের ব্যাপক প্রচলন ছিল । সে সময়ে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা শিশুকন্যাকে পাত্রস্থ করার জন্য উদগ্রীব ছিল । উচ্চবংশীয় পাত্র পেলে যেকোনো বয়সি মেয়েকে তার সাথে বিবাহ দেওয়া হতো । এ অবমাননাকর প্রথার বিরুদ্ধে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আন্দোলন করেন এবং তিনি অনেকাংশে সফলও হন ।


৩. বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম : 


সমাজসংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান বর্ণনা কর

তৎকালীন হিন্দুসমাজে বহুবিবাহের প্রচলন ছিল। সেসময়ে একাধিক বিবাহ একটি সামাজিক রীতিতে পরিণত হয়েছিল । বহুবিবাহের ফলে নারীদের শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন নির্যাতন হতো। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই বহুবিবাহের বিরুদ্ধেও কঠোর সংগ্রাম করেন। তিনি বহুবিবাহের বিপক্ষে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য পঞ্চাশ হাজার মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন এবং বহুবিবাহ রোধ আইন করার জন্য সরকারের নিকট আবেদন জানান ।


৪. শিক্ষাসংস্কার : 


ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এদেশের শিক্ষাসংস্কারে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি প্রথম সংস্কৃত কলেজে মাতৃভাষায় পড়াশুনার প্রচলন করেন এবং ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন ও ইংরেজিকে আবশ্যিক হিসেবে পাঠ্য করেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এদেশে ছাত্ররা বাংলা, সংস্কৃত ও ইংরেজির মাধ্যমে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আদর্শ ও ভাবধারা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ পায়। তিনি সরকারি শিক্ষাসংস্কার কমিটির সদস্য হিসেবে দেশীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটান। তিনি কলেজে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যগণের সংরক্ষিত প্রবেশাধিকার তুলে দেন এবং যেকোনো হিন্দু ছাত্রদের জন্য কলেজের দ্বার খুলে দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে এক বিপ্লবের সূচনা করেন। এভাবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শিক্ষাসংস্কারের মাধ্যমে এদেশে সমাজসংস্কারে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখেন।


৫. সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজসংস্কার : 


ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সাহিত্যের মাধ্যমেও সমাজসংস্কারে অসামান্য অবদান রাখতে সমর্থ হন। বাংলা সাহিত্যের উন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধনে তিনি বহু পুস্তক রচনা করেন। তাঁর মোট সাহিত্যকর্মের সংখ্যা ৫২টি। অধকাংশ বইয়ে তিনি সমাজের নানা অসংগতি তুলে ধরেন এবং উক্ত অসংগতি কীভাবে দূর করা যায় সে সম্পর্কে আলোকপাত করেন ।  এছাড়া ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একজন দক্ষ অনুবাদক ছিলেন। 


৬. নারী শিক্ষার বিস্তার : 


ভারতীয় উপমহাদেশের নারীদের শিক্ষার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল অসামান্য। তৎকালীন বেথুন সাহেবের মাধ্যমে "দ্যা হিন্দু ফিমেল” কলেজ প্রতিষ্ঠা হলে তিনি এর অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন এবং উক্ত কলেজের ছাত্রীদেরকে আদর্শ ও সংস্কারমনা মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। এছাড়াও তাঁর প্রচেষ্টায় তৎকালে মোট ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় যা পরবর্তীতে সমাজসংস্কারের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে ।


৭. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন : 


ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর প্রচেষ্টায় বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। তিনি তাঁর প্রচেষ্টায় ১০০টি বঙ্গ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৫৩ সালে তিনি তাঁর জন্মভূমিতে একটি অবৈতনিক ইংরেজি স্কুল ও কর্মজীবীদের জন্য একটি নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৯ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সরকারি চাকরি ছেড়ে কলকাতা মেট্রোপলিটন স্কুলের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং ১৮৭২ সালে এ স্কুলে কলেজ সেকশন চালু করেন । তাঁর প্রচেষ্টায় এটি একটি আদর্শ কলেজে পরিণত হয় এবং বর্তমানে এ কলেজটি বিদ্যাসাগর কলেজ নামে পরিচিত।

 ৮.  নারীদের সামাজিক অবস্থার উন্নতি সাধন :


সমাজসংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান বর্ণনা কর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সময় এ অঞ্চলের নারীরা অবহেলার পাত্র ছিল । তিনি যথার্থভাবে উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন যে, নারীদের যথাযথ শিক্ষায় শিক্ষিত করা গেলে তারা নিজেদের উন্নয়ন নিজেরাই করতে পারবে। তিনি নারীদেরকে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য যথাযথ পরিশ্রম করেন এবং অনেকাংশে সফলও হন ।


উপসংহার : 

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উপমহাদেশের সমাজসংস্কার আন্দোলন আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। তৎকালীন হিন্দুসমাজে হিন্দু বিধবা মহিলাদের পুনঃবিবাহ না হওয়ার ফলে সমাজে বিভিন্ন সমস্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমাজে হিন্দু বিধবা মহিলাদের পুনঃবিবাহের ব্যবস্থা করে সমাজসেবায় অসামান্য অবদান রাখেন। তিনি শুধু হিন্দু বিধবাবিবাহের প্রচলনই করেননি; বরং নিজের ছেলেকে হিন্দু বিধবা মহিলার সাথে বিবাহ দিয়েছেন।

 


Post a Comment

Previous Post Next Post