উমাইয়া বংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মুয়াবিয়া (রা.) এর কৃতিত্ব আলোচনা কর।

উমাইয়া বংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মুয়াবিয়া (রা.) এর কৃতিত্ব আলোচনা কর।

উমাইয়া বংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মুয়াবিয়া (রা.) এর কৃতিত্ব আলোচনা কর। 


ভূমিকা:


মুয়াবিয়া (রা.) ছিলেন আরব বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন ইসলামের একজন একনিষ্ঠ সেবক। মহানবি (সা.) এর সময় থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। বিদ্রোহীদের হাতে হযরত ওসমান (রা.) শাহাদাত বরণ করলে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং হযরত আলি (রা.) এর শাসনামলে সিরিয়ায় তার অবস্থানকে আরও পাকাপোক্ত করে ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। নব প্রতিষ্ঠিত এ বংশের প্রথম শাসক হিসেবে তিনি ইতিহাসের পাতায় বিশেষ স্থান দখল করেন ।

উমাইয়া বংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মুয়াবিয়া (রা.) এর কৃতিত্ব: নিম্নে উমাইয়া বংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মুয়াবিয়া (রা.) এর কৃতিত্ব আলোচনা করা হলো:

 

১. মুয়াবিয়া (রা.) এর রাজনীতিতে পদাপর্ণ:  


মুয়াবিয়া (রা.) মহানবি (সা.) এর সময় থেকেই রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তবে তার রাজনৈতিক জীবনের পূর্ণসূচনা ঘটে হযরত ওমর (রা.) এর রাজত্বকালে। হযরত ওমর (রা.) তাকে সিরিয়ার শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করলে; তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ দায়িত্ব পালন করে হযরত ওমর (রা.) এর বিশ্বস্ততা অর্জন করেন।

 

২. সিরিয়ায় শক্তিশালী অবস্থান তৈরি: 


মুয়াবিয়া (রা.) হযরত ওসমান (রা.) এর সময়েও সিরিয়ার শাসক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। হযরত ওসমান (রা.) এর শাসনামলের শেষ ছয় বছরে ষড়যন্ত্রকারীরা, বিশেষত মুনাফিকরা ইসলামের বিরোধিতায় তৎপর হলে মুয়াবিয়া (রা.) তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন। কিন্তু ষড়যন্ত্র ব্যাপকভাবে ডালপালা বিস্তার করলে খলিফা হযরত ওসমান (রা.)-কে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করতে হয়। এমতাবস্থায় মুয়াবিয়া (রা.) ইসলামের স্বার্থে সিরিয়ায় তার অবস্থানকে শক্তিশালী করে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান ।


৩. হযরত আলি (রা.) এর সাথে মতবিরোধ: 


হযরত আলি (রা.) হযরত ওসমান (রা.) এর শাহাদাতের পর ইসলামের চতুর্থ খলিফা হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। অত্যন্ত জটিল ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশে ইসলামি খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরিস্থিতি সামাল দিতে থাকেন। কিন্তু হযরত ওসমান (রা.) এর শাহাদাতের বিচার ও অন্যান্য কয়েকটি বিষয় নিয়ে তাঁর ও মুয়াবিয়া (রা.) এর মধ্যে  মতবিরোধ দেখা দেয়। এ মতবিরোধ শেষ পর্যন্ত সংঘর্ষে রূপ নেয়। ফলে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে উভয়ের মধ্যে বিখ্যাত সিফফিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধের ফলাফল মুয়াবিয়া (রা.) এর অনুকূলে গেলে সিরিয়ায় তার বংশ প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়। 

 

৪. ইসলামি সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব গ্রহণের উদ্যোগ:


সিফফিনের যুদ্ধের পর ইসলামের সর্বশেষ খলিফা হযরত আলি (রা.) শাহাদাতবরণ করলে মুয়াবিয়া (রা.) ইসলামি সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তবে এ সময় জনগণের একাংশ হযরত আলি (রা.) এর জ্যেষ্ঠপুত্র হযরত হাসান (রা.)-কে খলিফা হিসেবে মনোনীত করলে মুয়াবিয়া (রা.) ইসলামি সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব গ্রহণে তীব্র বাধার সম্মুখীন হন। অতঃপর হাসান (রা.) এর সাথে সমঝোতায় উপনীত হয়ে তিনি ইসলামি সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ।


শাসক হিসেবে মুয়াবিয়া (রা.) এর কৃতিত্ব: নিম্নে শাসক  হিসেবে মুয়াবিয়া (রা.) এর কৃতিত্ব আলোচনা করা হলো :

 

১. বংশ প্রতিষ্ঠা:


শাসক হিসেবে মুয়াবিয়া (রা.) এর অন্যতম কৃতিত্ব হলো নতুন বংশ প্রতিষ্ঠা। তিনি ইসলামি সাম্রাজ্যের  বিশৃঙ্খলা দূরীকরণের লক্ষ্যে সিরিয়ায় নিজের অবস্থান শক্তিশালী করে উমাইয়া বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রতিষ্ঠিত বংশ খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের মাঝামাঝি সময়, অর্থাৎ ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত টিকে ছিল।

 

২. রাজ্য সম্প্রসারণ:


শাসক হিসেবে মুয়াবিয়া (রা.) এর অনন্য কৃতিত্ব ছিল রাজ্যের সম্প্রসারণ বা রাজ্য বিজয়। মুয়াবিয়া (রা.) তার রাজ্য শাসনের শুরুর দিকেই আফগানিস্তান ও পারস্যে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন। তিনি ৬৬২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত লাগাতার অভিযান চালিয়ে কাবুল, কান্দাহার, বলখ, বুখারা, সমরখন্দ, তিরমিজ প্রভৃতি এলাকা দখল করেন। তার শাসনামলে হযরত ওকবা বিন নাফি উত্তর আফ্রিকা জয় করে এ অঞ্চলকে ইসলামি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। খ্রিস্টানদের বিখ্যাত শহর কন্সটান্টিনোপল অবরোধ ছিল মুয়াবিয়া (রা.) এর অসামান্য কীর্তি ।

 

৩. সাম্রাজ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা:


মুয়াবিয়া (রা.) শুধু রাজ্য বিজয়ই করেননি, তিনি বিজিত অঞ্চলসমূহে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়ভাবে মনোনিবেশ করেছিলেন। তার আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে বিজিত অঞ্চলসমূহসহ সমগ্র মুসলিম সাম্রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়।

 

৪. দক্ষ শাসক:


দক্ষ শাসকের যাবতীয় গুণ মুয়াবিয়া (রা.) এর মধ্যে বিদ্যমান ছিল। তিনি উদারতা ও কঠোরতার সংমিশ্রণে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তিনি শাসনকার্যকে সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার যাবতীয় জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলন ।


৫. রাজধানী স্থানান্তর: 


সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে রাজ্য পরিচালনার জন্য একটি বিশৃঙ্খলামুক্ত ও নিরাপদ রাজধানী অত্যন্ত জরুরি। তাই মুয়াবিয়া (রা.) ইসলামি সাম্রাজ্যের রাজধানী কুফা থেকে দামেস্কে স্থানান্তরিত করেন। তার সুদৃঢ় তত্ত্বাবধানে দামেস্ক তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী নগরীতে পরিণত হয়।


৬. প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস:


প্রশাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও গতিশীল করার লক্ষ্যে মুয়াবিয়া (রা.) প্রশাসনিক কাঠামোকে পুনর্বিন্যস্ত করেন। ফলে প্রশাসন ব্যবস্থা সুদৃঢ় হয় এবং সাম্রাজ্যের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পাদনে দক্ষতার পরিচয় দেয়।


৭. রাজস্ব সংস্কার: 


মুয়াবিয়া (রা.) রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করে একে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি সাহেবুল খারাজ নামক কর্মকর্তার মাধ্যমে তার সাম্রাজ্যের রাজস্ব ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার শাসনামলে রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কারের ফলে সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়।


৮. নৌবাহিনী গঠন: 


মুয়াবিয়া (রা.) এর শাসনামলে নৌবাহিনী গঠন ছিল ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ইসলামের ইতিহাসে তিনিই প্রথম একটি সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলেন। তাঁর নৌবাহিনী বিভিন্ন নৌ যুদ্ধে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে । তার প্রতিষ্ঠিত নৌবাহিনীর সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল কন্সটান্টিনোপল অবরোধ ।


৯. ডাক বিভাগ প্রতিষ্ঠা:


বিশাল সাম্রাজ্যের সব জায়গার খবরাখবর যথাযথ আদান প্রদানের স্বার্থে মুয়াবিয়া (রা.) ডাক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। এ বিভাগকে আরবিতে 'দিওয়ানুল বারিদ' ও এ বিভাগের প্রধানকে 'সাহিবুল বারিদ' বলা হতো । ঘোড়া ও উটের মাধ্যমে ডাক বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো ।

 

১০. গুপ্তচর বিভাগ প্রতিষ্ঠা:


একটি রাজ্য বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী অত্যন্ত জরুরি। তাই হযরত মুয়াবিয়া (রা.) একজন বিচক্ষণ শাসক হিসেবে একটি শক্তিশালী গুপ্তচর বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তিদের তার গুপ্তচর বিভাগের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো।

 

উপসংহার:


উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইসলামের ইতিহাসের প্রথম রাজা হিসেবে খ্যাত মুয়াবিয়া (রা.) ছিলেন তার সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ কূটনীতিবিদ। তিনি স্বীয় রাজনৈতিক জ্ঞানের মাধ্যমে একটি নতুন শাসনব্যবস্থা চালু করেন। তার প্রতিষ্ঠিত নব্য শাসনব্যবস্থা উমাইয়া বংশের শাসন নামে পরিচিতি লাভ করে। এ বংশের প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে তিনি বিভিন্ন ধরনের কৃতিত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে ইসলামের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

 

 

 

 

Post a Comment

Previous Post Next Post