ওকাজ মেলা সম্পর্কে আলোচনা কর।
ভূমিকা :
প্রাক ইসলামি যুগে আরবের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে ওকাজ মেলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।এ মেলাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন আরবরা নানা উৎসবের আয়োজন করতো যা ছিল তাদের চিত্তবিনোদনের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম। এ মেলায় সংস্কৃতিমান আরবরা বিভিন্নভাবে তাদের সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ ঘটাত ।
ওকাজ মেলা
নিম্নে ওকাজ মেলা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১. ওকাজের অবস্থান :
হেজাজ প্রদেশের একটি স্থানের নাম ওকাজ। এটি মক্কার নিকটবর্তী নাখলা ও তায়েফের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এখানে প্রতিবছর বিখ্যাত ওকাজ মেলা হতো।
২. সময়কাল :
শাহরে হারাম তথা জিলকদ, মহররম, জিলহজ ও রজব মাসে ওকাজ মেলা অনুষ্ঠিত হতো। এ সময় যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ থাকায় শান্তির মাসগুলোতে ওকাজ মেলা হতো। বুখারি শরিফ ও তাফসিরে তাবারিতে উল্লেখ আছে হজের মৌসুমে ওকাজ মেলা হতো ।
৩. ওকাজ মেলার কার্যক্রম :
নিম্নে সংক্ষেপে ওকাজ মেলার কার্যক্রম উল্লেখ করা হলো-
ক. ব্যবসায়িক কার্যক্রম:
ওকাজ মেলায় আন্তঃআঞ্চলিক ও স্থানীয় পণ্যদ্রব্য প্রদর্শনের জন্য উপস্থাপন করা হতো। এতে আন্তর্জাতিক ও বৈদেশিক বাণিজ্যের পণ্য বিনিময় হতো।
খ. নৃত্য প্রদর্শন:
ওকাজ মেলায় পুরুষদের উত্তেজিত করে তোলার জন্য নর্তকীরা নৃত্য পরিবেশন করতো । পুরুষরা নৃত্যের কারণে উত্তেজিত হয়ে গেলে পুরুষরা তাদেরকে স্পর্শ করলে তাদের মূল্য বৃদ্ধি পেত ।
গ. জুয়াখেলা ও ঘোড়দৌড়:
ওকাজ মেলায় জুয়াখেলা ও ঘোড়দৌড় অন্যতম আকর্ষণ ছিল। বিভিন্ন গোত্র থেকে বাছাই করা মল্লযোদ্ধারা এতে অংশগ্রহণ করলে তাদের মান মর্যাদা বৃদ্ধি পেত। এছাড়া ঘোড়দৌড়ে সর্বোচ্চ নৈপুণ্য প্রদর্শনকারী ঘোড়াকে নিয়ে আরবরা গর্ব করতো।
ঘ. কাব্যসাহিত্য চর্চা:
ওকাজ মেলায় গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম ছিল কাব্যসাহিত্য চর্চা। প্রতিবছর আরবের বিখ্যাত কবিগণ সাহিত্যের আসরে কাব্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতো। বিচারকমণ্ডলীর রায়ে যেসব কবির কাব্য প্রথম স্থান অধিকার করতো সেসব কাব্য মিসরীয় বস্ত্রে লিপিবদ্ধ করে কাবাগৃহের দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হতো। হাম্মাদুল মারিয়া নামে এক বিখ্যাত সাহিত্যিক এ কবিতাগুলো সাবআ মুয়াল্লাকাত নামে নামকরণ করেন ।
উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায় যে, ইসলামপূর্ব যুগে আরব সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশে ওকাজ মেলার গুরুত্ব অপরিসীম। এ মেলাটি আরবদের সৃজনশীল মনোভাবের পরিচয় বহন করার পাশাপাশি তা ছিল আরববাসীর বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। এটি ছিল প্রাক ইসলামি আরবের শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক উৎসব ।
সাবাআ
মুয়াল্লাকাত সম্পর্কে টীকা লেখ।
ভূমিকা :
প্রাক ইসলামি যুগে আরবের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছালেও তাদের সাংস্কৃতিক অবস্থা অত্যন্ত উন্নত ছিল। আরবে গীতিকাব্যগুলো সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ ছিল। তন্মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো সাবআ মুয়াল্লাকাত । এটি আরবদের উন্নত সাহিত্য চর্চা ও কবিতা রচনার স্বাক্ষর বহন করে।
সাবআ মুয়াল্লাকাত :
সাবাআ মুয়াল্লাকাত আরবি শব্দ। এর অর্থ সাতটি ঝুলন্ত কবিতা। প্রাচীন আরবের লোকেরা মক্কার অনতিদূরে ওকাজ নামক স্থানে প্রতিবছর কবিতা পাঠের আয়োজন করতো। এ কবিতা পাঠের পর শ্রেষ্ঠ কবিতাসমূহ মিসরীয় বস্ত্রে লিপিবদ্ধ করে কাবাগৃহের দেওয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। হাম্মাদুল মারিয়া নামক এক বিখ্যাত ব্যক্তি এ কবিতাগুলোর নাম দেন সাবআ মুয়াল্লাকাত ।
সাবআ মুয়াল্লাকাতের খ্যাতনামা কবিগণ :
সাবআ মুয়াল্লাকাতের খ্যাতনামা
কবিগণের মধ্যে ছিলেন
১. ইমরুল কায়েস,
২. আমর বিন কুলসুম,
৩. লবিদ বিন রাবিয়াহ,
৪. আনতারা বিন শাদ্দাদ,
৫. তারাফা বিন আদ,
৬. হারিছ বিন হিল্লিজা এবং
৭. জুহাইর বিন আবি সালমা । এদের মাঝে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন ইমরুল কায়েস ।
সাবআ মুয়াল্লাকাতের বিষয়বস্তু :
নিম্নে সাবআ মুয়াল্লাকাতের বিষয়বস্তু সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
১. প্রেম :
সাবআ মুয়াল্লাকাতের মূল বিষয়বস্তু ছিল প্রেম। প্রেমসংক্রান্ত কবিতা লেখার ব্যাপারে ইমরুল কায়েস অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। তাঁর বর্ণনায় প্রেমিকার রূপের বর্ণনা ও অভিসারের ঘটনাবলি প্রভৃতি উল্লিখিত থাকতো ।
২. যুদ্ধবিগ্রহ :
আরবদের নিত্যনৈমিত্তিক ছিল যুদ্ধ বিগ্রহ । তারা দীর্ঘ নয় মাস যাবৎ যুদ্ধ করতো। যুদ্ধের মাধ্যমে তারা তাদের কাজে উৎসাহ পেত। সাবআ মুয়াল্লাকাতে অত্যন্ত উজ্জ্বলভাবে যুদ্ধবিগ্রহের বর্ণনা ফুটে উঠেছে। যুদ্ধে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার জন্য কবিতা একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কাব বিন জুহাইর যুদ্ধসংক্রান্ত কবিতা লেখায় প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন।
৩. সমাজের প্রতিচ্ছবি :
সাবআ মুয়াল্লাকাত কবিতায় অত্যন্ত সুনিপুণভাবে সমাজের প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত হতো। আমর বিন কুলসুমের কবিতায় খুব সুন্দরভাবে বেদুইন সমাজের অবস্থা চিত্রিত হয়েছে। তাছাড়া কবি লাবিদ বিন রাবিয়াহর কবিতায় মরু জীবনের বিভিন্ন দিক ফুটে উঠেছিল।
৪. প্রকৃতির বর্ণনা :
সাবআ মুয়াল্লাকাতের কবিতাগুলোতে সুনিপুণভাবে প্রকৃতির বর্ণনা উপস্থাপিত হতো। কবি হারিস বিন হিল্লিজার বর্ণনায় প্রকৃতির বর্ণনা অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছিল ।
৫. নারীর সৌন্দর্যের বর্ণনা :
সাবআ মুয়াল্লাকাতের কবিতায় প্রধান উপজীব্য ছিল নারীর সৌন্দর্যের বর্ণনা। এ কবিতাসমূহে নারীর চালচলন, পোশাক পরিচ্ছদ, চোখ, ঠোঁট, মুখসহ বিভিন্ন বিষয় সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হতো। সাবআ মুয়াল্লাকাতের শ্রেষ্ঠ কবি ইমরুল কায়েস এ ব্যাপারে পারদর্শী ছিলেন।
উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাক ইসলামি যুগের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে আরবের কবিগণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাদের কবিতায় আরবের সমাজব্যবস্থা, আতিথেয়তা, স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে । বর্তমানেও এ সাতজন কবি ইতিহাসে দীপ্তিমান হয়ে আছেন ।
ইমরুল কায়েস সম্পর্কে যা জান লেখ।
ভূমিকা :
প্রাক ইসলামি যুগের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ সাবআ মুয়াল্লাকাত রচনায় প্রসিদ্ধ কবিদের মাঝে ইমরুল কায়েস শ্রেষ্ঠ ছিলেন । তিনি তার স্বীয় কাব্যপ্রতিভার জন্য আজও বিশ্বের ইতিহাসে সুপরিচিত। তার কাব্যপ্রতিভা যুগ যুগ ধরে মানুষের কাছে অমর হয়ে থাকবে ।
ইমরুল কায়েস : নিম্নে ইমরুল কায়েস সম্পর্কে আলোচনা করা হলো
১. ইমরুল কায়েসের পরিচয়:
ইমরুল কায়েস দক্ষিণ আরবের এক প্রাচীন রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল হজর এবং মাতার নাম ছিল তামনুক । বনু তাঘলিব গোত্রের কবি মুহালহিল ইমরুল কায়েসের মামা ছিলেন। কবি মুহালহিল সর্বপ্রথম আরবি সাহিত্যে কাব্য রচনা করেন। মাতৃকুল থেকে ইমরুল কায়েস তার কবিত্ব শক্তি উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলেন। তার কাব্যপ্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে ইউরোপীয় সমালোচকগণ তাকে আরবের সেক্সপিয়র (Shakespeare of the Arabs) হিসেবে অভিহিত করেন ।
২. ইমরুল কায়েসের কবিতার বিষয়বস্তু:
অসাধারণ কাব্য প্রতিভার অধিকারী ইমরুল কায়েস। জাহেলিয়া যুগের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে ইমরুল কায়েসের কবিতার বিষয়বস্তু নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
ক. প্রেমের বর্ণনা :
ইমরুল কায়েসের কবিতায় প্রেম ও প্রেমাভিসারের বর্ণনা রয়েছে। তিনি বিভিন্ন উপমা ব্যবহারের মাধ্যমে প্রেমিকের বর্ণনা করেছিলেন। তার কবিতায় চাচাতো বোনের প্রতি ভালোবাসা এবং তাদের প্রেমাভিসারের বর্ণনা রয়েছে। ইমরুল কায়েস তার কবিতার মাধ্যমে প্রকৃত প্রেমের লীলা বৈচিত্র্য খুবই নগ্নভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
খ. নারীর বর্ণনা :
ইমরুল কায়েস নারীর সৌন্দর্য নিয়ে প্রচুর কবিতা রচনা করেছেন। তিনি নারীকে চঞ্চলা হরিণী ও বন্য গাভীর সাথে তুলনা করেছেন। আরবদের অমার্জিত আবেগ ও উদ্দাম কামাচার ইত্যাদি তার কবিতার অন্যতম বিষয়বস্তু ছিল।
গ. বিরহের বর্ণনা :
ইমরুল কায়েস তার বর্ণনায় পাঠকের হৃদয় আলোড়িত করে বিরহের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে দুর্গম পথ ও পথকষ্টের বর্ণনা প্রদান করেছেন। তিনি তার কবিতার মাধ্যমে পরিত্যক্ত বাস্তুভিটার যাত্রাবিরতি করে প্রিয়ার স্মরণে অশ্রু বিসর্জনের পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। ইমরুল কায়েস তার কষ্ট ভারাক্রান্ত হৃদয়ের অভিব্যক্তি কবিতায় সুরে সুরে উপস্থাপন করেছেন ।
ঘ. জীবনের বাস্তবতার বর্ণনা:
ইমরুল কায়েসের কবিতার মাধ্যমে বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি চিত্রায়িত হয়েছে। তার কবিতায় একই সাথে বাদশাহি মেজাজ, অভাব, অনটন ও সহায় সম্বলহীনতার চিত্র প্রকাশিত হয়। তিনি ছন্দের অলঙ্করণে এবং সুরের মূর্ছনায় অভিজ্ঞতার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন।
৩. প্রকৃতির বর্ণনা :
ইমরুল কায়েস চিত্র ও ভাবের সাথে সংগতি রেখে শব্দ চয়ন করতেন। তার প্রকৃতির সূক্ষ্ম বর্ণনা অনুপম চিত্রের সাথে তুলনীয়। তিনি তার মুয়াল্লাকাতের শেষ আটটি শ্লোকে ঝড় বৃষ্টির একটি সুন্দর চিত্র তুলে ধরেছেন।
উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায় যে, ইমরুল কায়েস
তার কবিতায় ভাষার প্রাঞ্জলতা, উৎপ্রেক্ষার অভিনবত্ব, উপমা, ছন্দের পরিপাটির
মাধ্যমে সচল ও সজীব অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। ইউরোপীয় সমালোচকগণও তার উৎকৃষ্ট
শব্দচয়ন, সাবলীল রচনাশৈলী ও চমকপ্রদ ছন্দ লহরিতে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ফলে তাকে আরবের
সেক্সপিয়র উপাধি দিয়েছেন।