হযরত আবু বকর (রা.)-কে ইসলামের ত্রাণকর্তা বলা হয় কেন?

হযরত আবু বকর (রা.)-কে ইসলামের ত্রাণকর্তা বলা হয় কেন?

হযরত আবু বকর (রা.)-কে ইসলামের ত্রাণকর্তা বলা হয় কেন?

ভূমিকা :

হযরত আবু বকর (রা.) ছিলেন ইসলামের প্রথম খলিফা। মহানবি (সা.)-এর তিরোধানের পর ইসলাম এবং মুসলিম রাষ্ট্র খলিফাশূন্য হয়ে পড়লে খিলাফত নিয়ে নানারকম জটিলতার সৃষ্টি হয়। মুসলমানদের এরূপ সংকটময় মুহূর্তে হযরত আবু বকর (রা.) ইসলামের প্রথম খলিফা হিসেবে খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মুসলিম রাজ্যের বিশৃঙ্খলা, অরাজকতায় পরিপূর্ণ পরিস্থিতি তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করেন। এজন্য তাঁকে ইসলামের ত্রাণকর্তা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় ।

ইসলামের ত্রাণকর্তা হিসেবে হযরত আবু বকর (রা.)-এর কৃতিত্ব :

৬৩২ খ্রিস্টাব্দে মহানবি (সা.)-এর ইন্তেকালের পর হযরত আবু বকর (রা.)-এর খিলাফতকালে মুসলিম সাম্রাজ্যের ভরাডুবিময় অবস্থা বিরাজ করলে তিনি অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে তা মোকাবিলা করেন। তার এরূপ কৃতিত্বের জন্যে তিনি ইসলামের ত্রাণকর্তা হিসেবে অভিহিত হন। ইসলামের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবু বকর (রা.)-এর কৃতিত্ব নিম্নে আলোচনা করা হলো : 

১. সিদ্দিক উপাধি লাভ: 

মহানবি (সা.)-এর ইসলামের বাণী বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষদের মধ্যে হযরত আবু বকর (রা.) সর্বপ্রথম বিশ্বাস করেন এবং নির্দ্বিধায় মহানবি (সা.)-এর নিকট ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এছাড়া মহানবি (সা.)-এর মিরাজ গমনের ঘটনা শুনামাত্রই তিনি বিশ্বাস করেছিলেন। এজন্য মহানবি (সা.) তাকে 'সিদ্দিক' বা বিশ্বাসী উপাধি দান করেছিলেন ।

২. ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ:

হযরত আবু বকর (রা.) ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। বিপদ আপদে, সুখ দুঃে শান্তি সংগ্রামে তিনি মহানবি (সা.)-কে ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। ইসলামকে রক্ষায় তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। ঐতিহাসিক মুর বলেছেন, অসহ্য জুলুম ও বিরোধিতার মুখেও তিনি রাসুলে কারিমের প্রচারিত জীবন বিধানের প্রতি বলিষ্ঠ ইমান পোষণ করতেন এবং ইসলামের জন্য যেকোনো দুঃখকষ্ট ও বিপদ বরণ করতে প্রস্তুত থাকতেন।" হযরত আবু বকর (রা.)-এর প্রচেষ্টাতেই হযরত ওসমান, তালহা, জুবায়ের, আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা.) প্রমুখ গণ্যমান্য ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন । 

৩. ইসলামের খেদমতে সর্বস্ব দান:

হযরত আবু বকর (রা.) তার জীবন সম্পদ, প্রাপ্তি-প্রত্যাশা, সম্মান সবকিছু ইসলামের সেবায় উৎসর্গ করেছেন। তিনি তাঁর উপার্জিত সব সম্পদ ইসলামের খেদমতে দান করেন। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেছেন, আবু বকরের ধন সম্পদ ছাড়া অন্য কারো ধন সম্পদ আমার এত উপকারে আসেনি।

৪. রাসুল (সা.)-এর সন্তুষ্টি অর্জন:

হযরত আবু বকর (রা.) রাসুল (সা.)-এর এত বেশি সন্তুষ্টি অর্জন করেন, যা আর কেউ অর্জন করতে পারেনি। রাসুল (সা.) অসুস্থ থাকাকালে তাঁর জীবনের শেষ তিন দিনের ইমামতি করার সুযোগ তাঁকেই দিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে হযরত ওমর (রা.) বলেন, আবু বকরকে ইসলামের খেদমতের ব্যাপারে কেউ অতিক্রম করতে পারবে না।

৫. খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ:

মহানবি (সা.)-এর ওফাতের পর মুসলিম জাহানে খিলাফতের প্রশ্নে চরম অরাজকতার সৃষ্টি হলে হযরত আবু বকর (রা.) অত্যন্ত প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সাথে সব সমস্যার সমাধান করেন এবং সকলের অনুরোধে তিনি মুসলিম খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করে মুসলিম সাম্রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন ।

৬. গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা:

হযরত আবু বকর (রা.) ছিলেন একজন গণতান্ত্রিক শাসক। শাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি খলিফা হিসেবে জাতির উদ্দেশে যে তেজদীপ্ত ভাষণ দান করেন তাতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার রীতিনীতি সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন। 

৭. মহানবি (সা.)-এর দাফন সম্পাদন:

 মহানবি (সা.)-এর মৃত্যুর পর মুসলমানদের মধ্যে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। এ রকম পরিস্থিতিতে হযরত আবু বকর (রা.) ধৈর্যহারা না হয়ে সাহসিকতার সাথে সাহাবিগণকে ধৈর্য ধরার আহ্বান করেন এবং দাফন কাজ সম্পাদন করেন।

হযরত আবু বকর (রা.)-কে ইসলামের ত্রাণকর্তা বলা হয় কেন?

৮. স্বধর্মত্যাগীদের দমন:

মহানবি (সা.)-এর ওফাতের পর হেজাজ ছাড়া প্রায় সমগ্র আরবদেশে ইসলাম ধর্ম ও নবপ্রতিষ্ঠিত মুসলিম ধর্মের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ শুরু হয়। বিশেষ করে বেদুইন গোত্রের প্রায় সবাই তাদের পূর্বের ধর্মে ফিরে যেতে শুরু করে। ইসলামের সাথে তারা সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করেন। হযরত আবু বকর (রা.) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে এদেরকে কঠোর হস্তে দমন করে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক P. K. Hitti বলেন, "বিচ্ছিন্নতাকামীদের নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ বা ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আবু (রা.) ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। [History of the Arabs, P-141]

৯. ভন্ড নবিদের দমন:

মহানবি (সা.)-এর ওফাতের পর স্বধর্মত্যাগী বিদ্রোহী গোত্রের দলপতিরা নিজেদের নবি বলে দাবি করতে থাকে। হযরত আবু বকর (রা.) তোলায়হা, সাজাই, ন মুসায়লামা প্রমুখ ভণ্ড নবিদের কঠোর হস্তে দমন করেন।

১০. জাকাত প্রদানে অবাধ্যদের দমন:

হযরত আবু বকর (রা.)- এর খিলাফতকালে একদল লোক জাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। হযরত আবু বকর (রা.) অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কঠোর হস্তে তাদের দমন করেন । ফলে তারা জাকাত প্রদানে বাধ্য হয়। 

১১. কোরআন সংকলন:

হযরত আবু বকর (রা.)-এর খিলাফত দ গ্রহণের পর ভণ্ড নবি ও ধর্মত্যাগীদের বিদ্রোহ দমন করেন। ইয়ামামার যুদ্ধে অনেক হাফেজে কোরআন শহিদ হন। ফলে ল কোরআন মাজিদ সংরক্ষণ হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। এরূপ পরিস্থিতিতে হযরত ওমর (রা.)-এর পরামর্শে হযরত আবু বকর (রা.) কোরআনের সুরাগুলোকে লিপিবদ্ধ করে সমগ্র কোরআন সংকলন করেন ।

১২. সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা: 

হযরত আবু বকর (রা.)-এর কাছে সব মানুষ সমান ছিলেন । তিনি ধনী গরিবের বৈষম্য করতেন না । একজন খলিফা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তিনি তফাৎ করতেন না। এ সম্পর্কে মওলানা মুহম্মদ আলি বলেন, একজন সাধারণ মানুষের মতো রাজা (খলিফা) সমাজের একজন সদস্য।

১৩. ন্যায়বিচারক: 

হযরত আবু বকর (রা.) তাঁর খিলাফতকালে ইসলামের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা কোনো অন্যায় করতে পারে না। এ মতবাদ তিনি বিশ্বাস করতেন না। তিনি তাঁর শাসনব্যবস্থায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

১৪. ইসলামি রাজ্য সম্প্রসারণ:

হযরত আবু বকর (রা.) খিলাফতে অধিষ্ঠিত হয়ে আমর বিন আল আস ও খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে পরাজিত করে দক্ষিণ সিরিয়া দখল করেন । এছাড়া তিনি পারস্য ও বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য দখল করে ইসলামী রাজ্য সম্প্রসারণ করেন ।

উপসংহার:


উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ত্রাণকর্তা হিসেবে হযরত আবু বকর (রা.)-এর নাম ইসলামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। তিনি নিজে সারাটি জীবন ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন। ইসলাম ও ইসলামি রাষ্ট্রকে রক্ষার জন্য তিনি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন তা সত্যিই দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে। মওলানা মুহম্মদ আলি যথার্থঃ বলেছেন, "প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে ইসলামের তরিকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার একমাত্র কৃতিত্ব তাঁরই। 

Post a Comment

Previous Post Next Post