হুদায়বিয়া সন্ধির শর্তসমূহ লেখ। ইসলামের ইতিহাসে এ সন্ধিকে মহাবিজয় বলা হয় কেন?
ভূমিকা :
মহানবি
(সা.) মদিনায় হিজরত করার পর ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ওমরাহ পালন ও মাতৃভূমি দর্শনের জন্য
চৌদ্দশ সাহাবি নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা দেন। কিন্তু পথিমধ্যে হুদায়বিয়া নামক
স্থানে কুরাইশদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সেখানে তাঁবু স্থাপন করেন।
হুদায়বিয়াতে কুরাইশদের সাথে মহানবি (সা.)-এর একটি সন্ধি হয়, যা ইতিহাসে
হুদায়বিয়া সন্ধি নামে পরিচিত । হুদায়বিয়া সন্ধির ফলে মহানবি (সা.) ঐ বছর হজ না
করে মদিনায় ফিরে আসেন। হুদায়বিয়া সন্ধির ফলে দ্রুত ইসলামের বিকাশ ঘটে। তাই আল
কোরআনে এই সন্ধিকে মহাবিজয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ।
হুদায়বিয়া সন্ধির শর্তসমূহ :
৬২৮ খ্রিস্টাব্দে হুদায়বিয়া নামক স্থানে মুসলমান ও কুরাইশদের মধ্যে স্বাক্ষরিত হুদায়বিয়া সন্ধির শর্তসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১.
এ বছর অর্থাৎ ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানগণ হজ না করে মদিনায় ফিরে যাবে ।
২.
পরবর্তী বছর মুসলমানগণ হজ করতে পারবে কিন্তু তিনদিনের বেশি মক্কায় অবস্থান করতে
পারবে না। এ সময় মুসলমানগণ হজ করতে আসলে কুরাইশরা ঐ তিনদিন মক্কার বাইরে অবস্থান
করবে।
৩.
হজের উদ্দেশ্যে মুসলমানদের মক্কায় আগমনকালে তারা কেবল নিজ নিজ আত্মরক্ষার জন্য
কোষবদ্ধ তরবারি ব্যতীত অন্যকোনো মারণাস্ত্র সাথে আনতে পারবে না।
৪.
মুসলমান ও কুরাইশদের মধ্যে পরবর্তী দশ বছর যুদ্ধ বন্ধ থাকবে।
৫.
কোনো মক্কাবাসী অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিরেকে মদিনায় আশ্রয় প্রার্থনা করলে মদিনার
মুসলমানগণ তাকে আশ্রয় দিতে পারবে না। পক্ষান্তরে, কোনো মুসলমান মদিনা হতে মক্কায়
চলে আসলে মক্কাবাসীদের ওপর তাকে প্রত্যার্পণের কোনো দায়িত্ব বর্তাবে না।
৬.
আরবের যেকোনো গোত্র ইচ্ছা করলে মুসলমান বা কুরাইশদের সাথে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হতে
পারবে। এতে কোনো পক্ষই কোনো আপত্তি করতে পারবে না।
৭.
মক্কার কোনো নাবালেগ তার অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত মুসলিমদের দলে যোগ দিতে পারবে
না। যোগদিলে মুসলিমরা তাকে ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে।
৮.
হজের সময় কুরাইশগণ মুসলমানদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করবে।
৯.
মক্কার বণিকগণ নির্বিঘ্নে মদিনার পথ দিয়ে সিরিয়া, মিসর প্রভৃতি দেশে বাণিজ্য
করতে পারবে।
১০.
চুক্তির মেয়াদকালে জনসাধারণের পূর্ণ নিরাপত্তা রক্ষিত হবে এবং একে অপরের কোনো
প্রকার ক্ষতিসাধন করতে পারবে না।
১১.
এ সন্ধি আগামী দশ বছর স্থায়ী হবে।
১২.
সন্ধির শর্তাবলি উভয়পক্ষ কর্তৃক পুরোপুরি পালিত হবে। কোনো পক্ষ সন্ধি চুক্তির
একটি শর্তও ভঙ্গ করলে পুরো চুক্তিপত্র বাতিল বলে বিবেচিত হবে।
ইসলামের ইতিহাসে হুদায়বিয়া সন্ধিকে মহাবিজয় বলার কারণ :
হুদায়বিয়া সন্ধিকে মহাবিজয় বা মক্কা বিজয়ের পথ সুগমকারী বলার কারণসমূহ নিম্নে ব্যাখ্যা করা হলো :
১. মহানবি (সা.)-এর নেতৃত্বের স্বীকৃতি :
হুদায়বিয়া
সন্ধিতে স্বাক্ষরের মাধ্যমে মক্কার কুরাইশরা সর্বপ্রথম মহানবি (সা.)-কে মদিনার
রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে লিখিত স্বীকৃতি প্রদান করে। এতে মুহম্মদ (সা.)-এর সম্মান ও
মর্যাদা অনেক গুণ বৃদ্ধি পায়। তিনি দ্রুত বিশ্বনেতায় পরিণত হন।
২. ইসলামের রাজনৈতিক মর্যাদা অর্জন :
হুদায়বিয়া
সন্ধিতে স্বাক্ষর করে কুরাইশরা সর্বপ্রথম ইসলামকে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি
প্রদান করে। ফলে ইসলাম রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিশ্বে দ্রুত বিকাশ লাভ করে ।
৩. যুদ্ধবিগ্রহ থেকে মুক্তি :
হুদায়বিয়া সন্ধি স্বাক্ষরিত হওয়ার ফলে কুরাইশ ও মুসলমানদের মাঝে দশ বছরের জন্য যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ফলে মুসলমানরা একাগ্রচিত্তে ইসলাম প্রচারের সুযোগ লাভ করে। এ সম্পর্কে ইসলামি বিশ্বকোষে বলা হয়েছে, এ সন্ধির ফলে মুসলমানরা ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহ থেকে মুক্তি পায় এবং তা ছিল বিজয়ের প্রথম পর্যায় ।
৪. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ :
হুদায়বিয়া
সন্ধির পর মুসলমানরা সর্বত্র অবাধে ব্যবসায় বাণিজ্য করার সুযোগ লাভ করে। ফলে তারা
অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত সমৃদ্ধি অর্জন করে।
৫. শ্রেষ্ঠ বীরদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ :
হুদায়বিয়া
সন্ধির পর খালিদ বিন ওয়ালিদ, আমর বিন আস ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ফলে ইসলামের
শক্তি বৃদ্ধি পায়। ঐতিহাসিক P. K. Hitti
বলেন, “খালিদ ও আমর ইসলামের সামরিক অভিযানে শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত
হয়েছিলেন।”
৬. ইসলামের দ্রুত প্রসার :
হুদায়বিয়া
সন্ধির পর ইসলাম প্রচার ও প্রসারের পথ দিন দিন বিস্তৃত হতে থাকে। ইসলামের
সৌন্দর্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য বুঝতে পেরে কুরাইশগণ দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ
করতে থাকে। উনিশ বছর কঠোর পরিশ্রমের পর যেখানে মুসলমানদের সংখ্যা হয়েছিল ১৪০০ জন
সেখানে হুদায়বিয়া সন্ধির দুই বছর পর মুসলমানদের সংখ্যা ১০,০০০ এ পৌঁছে যায়।
হুদায়বিয়া সন্ধির ফলে মুসলমানরা আরবের বাইরে বিভিন্ন দেশের রাজদরবারে গমন করে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকে। ফলে অল্পদিনের মধ্যে ইসলাম ধর্ম আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিস্তার লাভ করে । ঐতিহাসিক আজ জুহরি বলেন, “পৌত্তলিকদের মধ্যে এমন কোনো সুবিবেচক লোক ছিল না যে ইসলামের ছায়াতলে আসতে প্রলুব্ধ হয়নি।”
৭. চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বার উন্মোচন :
হুদায়বিয়া
সন্ধির পর ইসলাম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে দ্রুত সমৃদ্ধি
অর্জন করে। মুসলমানদের এ সমৃদ্ধি মাত্র দুই বছর পর অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ে
গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
৮. আল্লাহর ঘোষণা :
হুদায়বিয়া
সন্ধির কিছু শর্ত আপাতদৃষ্টিতে মুসলমানদের বিপক্ষে মনে হওয়ার কারণে সাহাবিরা
মনোক্ষুণ্ণ হন। কিন্তু মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনের ‘সুরা
ফাতহ' নাজিল করে এই সন্ধিকে মুসলমানদের জন্য ‘মহাবিজয়’
হিসেবে ঘোষণা দেন । তাই এই সন্ধিকে মহাবিজয় বলা হয় ।
৯. মক্কা বিজয়ের সূচনা :
ঐতিহাসিক এম ওয়াট বলেন, এতে “হুদায়বিয়া সন্ধির ফলে মক্কাবাসী মদিনা প্রজাতন্ত্রকে স্বাধীন তনি রাষ্ট্র এবং মুহম্মদ (সা.)-কে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে স্বীকার করে নেয়।” এ সন্ধির পর ইসলাম দ্রুত বিকাশ লাভ করে শক্তি | আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিস্তৃতি লাভ করে। হুদায়বিয়া সন্ধির পর মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে মহানবি (সা.) ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে ওয়ার বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করেন ।
উপসংহার :
উপর্যুক্ত
আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে সম্পাদিত হুদায়বিয়া সন্ধি
ছিল ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। হুদায়বিয়া সন্ধি স্বাক্ষরের থেকে
মাধ্যমে মহানবি (সা.) তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দেন। হুদায়বিয়া সন্ধিতে
মুসলমানদের কূটনৈতিক বিজয়ের ফলে মানরা ইসলাম দ্রুত বিকাশ লাভ করে । আল্লাহ তাআলা
এই সন্ধিকে । ফলে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ফাতহুম মুবিন বা মহাবিজয় হিসেবে উল্লেখ
করেছেন ।