মাওয়ালিদের পরিচয় দাও। উমাইয়াদের মাওয়ালী নীতি পর্যালোচনা কর।

মাওয়ালিদের পরিচয় দাও

মাওয়ালিদের পরিচয় দাও।  উমাইয়াদের মাওয়ালী নীতি পর্যালোচনা কর। 

উত্তরঃ

মাওয়ালি ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। সাধারণত অনারব নওমুসলিমদেরকেই মাওয়ালি বলা হতো। উমাইয়া শাসনব্যবস্থায় মাওয়ালিদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাওয়ালিরা আরব মুসলিমদের সমমর্যাদা পায়নি।

মাওয়ালিদের পরিচয় : 

খোলাফায়ে রাশেদুনের আমল থেকেই ইসলামি সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি পেতে থাকে। উমাইয়া আমলে এ সীমানা এশিয়া, আফ্রিকা অতিক্রম করে ইউরোপ পর্যন্ত পৌছায়। এ বিজয়ের ফলে মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। সাধারণত আরবের বাইরে যে সকল অনারব ইসলাম গ্রহণ করতো তাদের মাওয়ালি বলা হতো।

যুদ্ধবন্দি, মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দি বা দাস-দাসী ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে মাওয়ালির মর্যাদা লাভ করতো। সরকারি স্বীকৃতি প্রাপ্তির জন্য মাওয়ালিদের কোনো না কোনো আরব গোত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতে হতো। উমাইয়া সাম্রাজ্যে আরবদের তুলনায় মাওয়ালিরা সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল।

মুসলিম হলেও মাওয়ালিরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদা লাভ করতো। তাদের ওপর বৈষম্যমূলক বিভিন্ন কর চাপিয়ে দেওয়া হতো। অমুসলিমদের ন্যায় তাদের কাছ থেকেও খারাজ বা ভূমিকর আদায় করা হতো। তারা কখনোই আরব মুসলমানদের ন্যায় মর্যাদাবান হিসেবে গণ্য হতো না। 

পারসিক মাওয়ালিগণ জ্ঞান-বুদ্ধি ও ঐতিহ্য আভিজাত্যে আরবদের চেয়ে সেরা হলেও ইসলাম গ্রহণের ফলে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হতে হতো। কিন্তু পারসিক অভিজাত মাওয়ালিগণও আরবদের শ্রেষ্ঠত্ব মানতে রাজি ছিল না। শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নে আরবদের সাথে মাওয়লিদের যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূচনা হয় তা পরবর্তীকালে 'শুবিয়া' নামক একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে।

অতএব বলা যায় যে, অনারব নওমুসলিমরাই মাওয়ালি নামে পরিচিত ছিল। ইসলামের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই, ইসলামের দৃষ্টিতে সকল মুসলমানই সমান মর্যাদার অধিকারী। কিন্তু উমাইয়া খলিফাগণ অনারব নওমুসলিমদের আরব মুসলমানদের মতো মর্যদা প্রদান করতো না। তাই এক পর্যায়ে মাওয়ালিরা উমাইয়াদের বিরুদ্ধে আব্বাসিদের পক্ষে যোগদান করে উমাইয়াদের পতন ঘটায়।


উমাইয়াদের মাওয়ালি নীতি :

মাওয়ালিদের প্রতি উমাইয়া খলিফাদের মনোভাব ছিল সম্পূর্ণ নেতিবাচক ।নিম্নে মাওয়ালিদের প্রতি উমাইয়া নীতি পর্যালোচনা করা হলো :

১. দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক : 

উমাইয়ারা মাওয়ালিদের প্রথম শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদা দিত না। সমতা, সমমর্যাদা ও সম্মান লাভের যে আশা নিয়ে মাওয়ালিগণ ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন তাদের সে আশা উমাইয়ারা পূরণ করেনি । উমাইয়ারা তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করতো।

২. চাকরিতে বৈষম্য :

উমাইয়াগণ আরব আভিজাত্যে এতই অহংকারী হয়ে ওঠেন যে, তারা অনারব নওমুসলিমদের ঘৃণার চোখে দেখত । প্রশাসনিক কার্যে মাওয়ালিরা যথেষ্ট যোগ্য থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে হতো । উমাইয়ারাই বেশি প্রাধান্য পেত। চাকরিরত অনেক মাওয়ালি ঠিকমতো বেতন পেতনা।

৩. ধর্মীয়ক্ষেত্রে বৈষম্য :


ধর্মীয়ক্ষেত্রেও মাওয়ালিরা বৈষম্যের শিকার হতো। তাদের পেছনে কেউ নামাজ পড়তো না। তাদেরকে নামাজের সময় মসজিদের পিছনের সারিতে দাড়াতে হতো । কুফায় মাওয়ালিদের জন্য আলাদা মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। 

৪. চলাচলে বাঁধা সৃষ্টি :

উমাইয়াগণ মাওয়ালিদেরকে এতটাই নিচু চোখে দেখত যে রাস্তায় তাদের সাথে মাওয়ালিদের হাটাও নিষিদ্ধ ছিল। দামেস্ক, কুফা, বসরা প্রভৃতি নগরীগুলোতে মাওয়ালিদের রাস্তার পাশ থেকে মাথা নিচু করে হাটতে হতো ।

৫. বিবাহ ক্ষেত্রে বৈষম্য:

উমাইয়া আমলে একজন মাওয়ালি কোনো অবস্থাতেই আরব মাহিলাকে বিয়ে করতে পারত না। একজন সম্ভ্রান্ত, সুশিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান পারসিক মাওয়ালির সাথে একজন নিম্নমানের আরব কন্যার বিবাহ দেওয়াও সম্ভব ছিল না।

৬. পৃথক শাসনতন্ত্র চালু:

উমাইয়া খলিফাগণ আরব ও মাওয়ালিদের জন্য পৃথক পৃথক সংবিধান প্রণয়ন করেন। খোরাসানে মাওয়ালিদের জন্য এরূপ পৃথক শাসনতন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায় । 

৭. সামরিক ক্ষেত্রে বৈষম্য:

মাওয়ালিরা যুদ্ধ ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হতো। তাদেরকে শুধু পদাতিক বাহিনীতে ভর্তি করা হতো। তারা অশ্বারোহী বাহিনীতে স্থান পেত না। গনিমতের মাল থেকেও তাদেরকে বঞ্চিত করা হতো ।

৮. জিজিয়া আদায় :

ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিম প্রজাদের জান, মাল, ইজ্জতের নিরাপত্তা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার বিনিময়ে জিজিয়া কর দিতে হতো। কিন্তু স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও মাওয়ালিদের জিজিয়া দিতে বাধ্য করা হয় । হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এ আইন চালু করে ।

৯. খারাজ আদায় :

খারাজ হচ্ছে অমুসলিম প্রজাদের প্রদেয় ভূমি কর। কিন্তু মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মাওয়ালিদের নিকট থেকে জোর করে খারাজ আদায় করেন । 

১০. ভাতা বন্ধ :

উমাইয়া খলিফাদের অনেকেই মাওয়ালিদের বয়স্কভাতা, যুদ্ধাহত সৈনিকের ভাতা ও অন্যান্য ভাতা স্থগিত করেন। ফলে তারা অনেক দুর্দশায় পড়ে।

উপসংহার :

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উন্নত, সভ্য, শিক্ষিত ও নানা বিদ্যায় পারদর্শী বিপুল সংখ্যক মাওয়ালি উমাইয়াদের সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে সহায়তা করা সত্ত্বেও তারা সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়। এছাড়াও তাদের শিল্পকলা, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে অবদান ইসলামি সভ্যতাকে উন্নতির চরম শিখরে পৌছে দিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাওয়ালিদেরকে উমাইয়া খলিফাগণ অবমূল্যায়ন করতো। ফলশ্রুতিতে মাওয়ালিরা উমাইয়া বিরোধী আন্দোলন করে তাদের পতন ত্বরান্বিত করে ।

আব্বাসি আন্দোলনে মাওয়ালিদের ভূমিকা

ইসলামের মূলনীতি সমতা, সমমর্যাদা, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ ও সম্মান হলেও উমাইয়া খিলাফতে মাওয়ালিরা ছিল নিষ্পেসিত। ফলে শিক্ষিত ও সভ্য পারসিক মাওয়ালিগণ তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে। যা উমাইয়াদেরর পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আব্বাসি আন্দোলনে মাওয়ালিদের ভূমিকা: নিম্নে আব্বাসি আন্দোলনে মাওয়ালিদের ভূমিকা উল্লেখ করা হলো :


১. আব্বাসি আন্দোলনে সহায়তা :

আব্বাসিদের উমাইয়াবিরোধী আন্দোলনে মাওয়ালিরা তাদের সাথে যোগ দেয়। উমাইয়াদের অত্যাচারী হিসেবে প্রচার করলে উমাইয়াবিদ্বেষী পারসিক মাওয়ালিগণ তাদের সমর্থন জানায়।

২. শুবিয়া আন্দোলন :

ইসলামের দৃষ্টিতে আরব অনারব সকল মুসলিম সমান মর্যদার অধিকারী হলেও উমাইয়ারা অনারব । মুসলিম তথা মাওয়ালিদের তাদের সমকক্ষ মনে করতো না । অন্যদিকে পারস্যের অভিজাত মাওয়ালিরা আবার আরবদের তাদের সমকক্ষ মনে করতো না। আভিজাত্যের এই দ্বন্দ্ব পারস্যের মাওয়ালিগণ কর্তৃক শুবিয়া আন্দোলনের সূচনা করে এবং পতন ত্বরান্বিত হয়।

৩. আবু মুসলিমের উত্থান :


পারসিক মাওয়ালি আবু মুসলিমের উত্থান উমাইয়াদের পতনকে ত্বরান্বিত করে। আব্বাসি আন্দোলনের উদ্যোক্তা মুহম্মদ মৃত্যুর পূর্বে তদীয় পুত্র ইব্রাহিমকে নেতা নির্বাচিত করে যান এবং তাকে সাহায্য করার জন্য আৰু মুসলিম খোরাসানি নামক একজন পারসিক মাওয়ালিকে নিযুক্ত করেন। অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতাসম্পন্ন আবু মুসলিম আব্বাসি আন্দোলনের গতি সঞ্চার করেন।

৪. খোরাসান দখল :

আবু মুসলিমের প্রচারণায় খোরাসানে উমাইয়াবিরোধী ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে। খোরাসানের উমাইয়া গভর্নর নসর বিন সাইয়ার ভয়ে পলায়ন করলে আবু মুসলিম খোরাসান দখল করেন।

৫. কুফা দখল:

উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ান খোরসান দখলের সংবাদে আব্বাসি আন্দোলনের নেতা ইব্রাহিমকে হত্যা করে। ইব্রাহিমের মৃত্যু সংবাদে আবু মুসলিম মোটেও বিচলিত না হয়ে ত্বরিৎ গতিতে সৈন্য প্রেরণ করে কুফা দখল করেন। 

৬. আবুল আব্বাসকে খলিফা ঘোষণা:

আবু মুসলিমের কুফা দখলের সংবাদে আবুল আব্বাস গোপন আস্তানা থেকে বের হয়ে এসে কালো বস্ত্র পরিহিত অবস্থায় কুফার মসজিদে আগমন করেন। এ সময় আবু সালমা নামক জনৈক ব্যক্তি আবুল আব্বাসকে খলিফা ঘোষণা করেন।

৭. জাব যুদ্ধ ও উমাইয়াদের পতন :

আব্বাসকে খলিফা ঘোষণার সংবাদে উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ান আব্বাসিদের চূড়ান্ত শিক্ষা দেওয়ার জন্য পুত্র আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে ১,২০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত এই যুদ্ধে মারওয়ান বাহিনী আবু মুসলিম খোরাসানির বাহিনীর হাতে চরমভাবে পরাজিত হয়। খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ানও ধৃত এবং নিহত হন।

 

অতএব বলা যায় যে, আব্বাসি আন্দোলনে মাওয়ালিদের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। মাওয়ালিদের অসম্মান ও হেয় করে উমাইয়াগণ নিজেদের সর্বনাশ ডেকে এনেছিলেন। পক্ষান্তরে আব্বাসিরা মাওয়ালিদের প্রতিভার মূল্যায়ন করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেন আর এভাবেই এদের সহযোগিতায় আব্বাসি বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post