বিশ্বগ্রামের ধারণা কি? বিশ্বগ্রাম প্রতিষ্ঠার উপাদানসমূহ কি
কি? বিশ্বগ্রামের সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ বিস্তারিত ২০২৪:
বিশ্বগ্রাম ধারণা কি?
Concept of Global Village:
কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও বিখ্যাত দার্শনিক মার্শাল ম্যাকলুহান (Marshall McLuhan) সর্বপ্রথম Global Village কথাটি ব্যবহার করেন। ম্যাকলুহান ১৯১১ সালের ২১ জুলাই কানাডায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৮০ সালের ৩১ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। ইন্টারনেট আবিষ্কারের প্রায় ৩০ (ত্রিশ) বছর আগে তিনি এ সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন। ম্যাকলুহান ১৯৬২ এবং ১৯৬৪ সালে তাঁর প্রকাশিত দুটি গ্রন্থ 'The Gutenberg Galaxy : The Making of Typographic Man' 'Understanding Media'- Global Village বিশ্বগ্রামের ধারণা দেন।
বিশ্বগ্রাম ধারণার জনক কে? বিশ্বগ্রাম ধারণার জনক মার্শাল ম্যাকলুহান
বিশ্বগ্রাম এমন একটি শব্দ যেখানে গোটা পৃথিবীকে একটি গ্রাম হিসেবে
কল্পনা করা হয়। একটি গ্রামের সকল মানুষ যেমন খুব সহজেই তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে
একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের লোকজন পরস্পরের
সাথে সহজে যাতায়াত ও ভ্রমণ, গণমাধ্যম ও ইলেকট্রনিক যোগাযোগ যেমন— রেডিও, টেলিভিশন, টেলিফোন, মোবাইল, ইন্টারনেট ইত্যাদির মাধ্যমে
যুক্ত থাকতে পারে এবং এভাবেই একটি একক কমিউনিটিতে পরিণত হয়। তথ্যের এ আদান-প্রদান বিশ্বকে এতটাই কাছে নিয়ে
এসেছে যে, এটি এখন একটি গ্রাম বা Village হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
অক্সফোর্ড আমেরিকান ডিকশনারি অনুযায়ী গ্লোবাল ভিলেজ হচ্ছে, "The world considered a single community linked by telecommunication."
উইকিপিডিয়ার উদ্ধৃতি অনুযায়ী— গ্লোবাল ভিলেজ হলো "The Global Village is the Sociological and cultural structure."
পরিশেষে বলা যায়, বিশ্বগ্রাম বা গ্লোবাল ভিলেজ হচ্ছে এমন একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা যার আনুষঙ্গিক সকল কিছুই ইন্টারনেট/www তথা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মধ্যে পাওয়া যায়।
বিশ্বগ্রামের সুবিধাসমূহ
■ মানুষের জীবনদক্ষতা ও গতি বৃদ্ধি।
■ ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রসার এবং সহজতর লেনদেন।
■ অনলাইন লাইব্রেরি, অনলাইন ইউনিভার্সিটি, টেলি ও ভিডিও কনফারেন্স,
ই-বুক ইত্যাদির কল্যাণে শিক্ষার উন্নয়ন।
■ টেলিমেডিসিন।
■ সহজে বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল জানা।
■ মুহূর্তের মধ্যেই বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের খবর পাওয়া যায়
■ বিশ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে সংস্কৃতির বিনিময় করা যায় ।
■ ব্যবস্থাপনা খরচ কম।
■ যেকোনো বিষয়ে সহজে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলা যায় ৷
বিশ্বগ্রামের অসুবিধাসমূহ
■ ইন্টারনেট প্রযুক্তির ফলে অনেক ক্ষেত্রে তথ্যের গোপনীয়তা বজায় থাকছে না অর্থাৎ তথ্য চুরি হয়ে যাচ্ছে।
■ সাইবার আক্রমণ বাড়ছে। ই-বিজনেস, ই-কমার্স, ই-ব্যাংকিং ইত্যাদি হুমকির মুখে পড়ছে।
■সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে অবাধ তথ্য প্রবাহ ব্যক্তিগত জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যেমন-আশঙ্কাজনকভাবে বিবাহ- বিচ্ছেদ বৃদ্ধি পাচ্ছে, পরকীয়া প্রেমের বলি হয়ে মানুষের জীবনহানির মতো ঘটনাও ঘটছে।
■ডিজিটাল ডিভাইড় দ্রুত বাড়ছে। ফলে প্রযুক্তিগতভাবে অদক্ষ জনগণ কর্মহীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে।
■বিশ্বায়নের অবাধ প্রতিযোগিতায় পড়ে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ অনেকটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় শিল্পকারখানা হুমকির মধ্যে পড়েছে। তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে ।
■সহজেই গুজব, অসত্য বা মিথ্যা এবং বানোয়াট সংবাদ ছড়িয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে।
বিশ্বগ্রাম প্রতিষ্ঠার উপাদানসমূহঃ
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অগ্রগতির কল্যাণে বিশ্বগ্রাম বা গ্লোবাল ভিলেজ ধারণার সহজেই বাস্তবায়ন হয়েছে। বিশ্বগ্রাম প্রতিষ্ঠার প্রধান উপাদানসমূহ হলো :
(ক) হার্ডওয়্যার (Hardware)
(খ) সফটওয়্যার (Software)
(গ) নেটওয়ার্ক সংযুক্ততা বা কানেকটিভিটি (Network Connectivity)
(ঘ) ডেটা (Data)
(ঙ) মানুষের সক্ষমতা (Capacity)
নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ
(ক) হার্ডওয়্যার :
বর্তমান বিশ্বগ্রাম বা গ্লোবাল ভিলেজে যেকোনো ধরনের যোগাযোগ বা তথ্য আদান-প্রদানের জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন ধরনের হার্ডওয়্যার সামগ্রীর। হার্ডওয়্যারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— কম্পিউটার এবং এর সাথে সংযুক্ত যন্ত্রপাতি, ল্যান্ড বা মোবাইল ফোন, স্মার্ট ফোন, অডিও-ভিডিও রেকর্ডার, স্যাটেলাইট, রেডিও, টেলিভিশন এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নির্ভর বিভিন্ন ডিভাইস ৷
(খ) সফটওয়্যার :
বিশ্বগ্রাম প্রতিষ্ঠার জন্য হার্ডওয়্যারের পাশাপাশি সফটওয়্যার প্রয়োজন। সফটওয়্যারের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের অপারেটিং সিস্টেম, ব্রাউজিং সফটওয়্যার, কমিউনিকেটিং সফটওয়্যার, প্রোগ্রামিং ভাষা ইত্যাদি।
(গ) নেটওয়ার্ক সংযুক্ততা বা কানেকটিভিটি :
বিশ্বগ্রামের মেরুদণ্ড হলো নিরাপদভাবে রিসোর্স শেয়ার করার নেটওয়ার্ক বা কানেকটিভিটি যার মাধ্যমে বিভিন্ন উপাত্ত ও তথ্য এই গ্রামের প্রতিটি মানুষের নিকট পৌঁছাতে পারে। নিরাপদ তথ্য আদান- প্রদানই হচ্ছে বিশ্বগ্রামের মূল লক্ষ্য। নিরাপদ তথ্য প্রদানের জন্য প্রয়োজন নিরাপদ নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা বা কানেকটিভিটি। কানেকটিভিটির মাধ্যমে মানুষ যখন যেখানেই অবস্থান করুক না কেন সবসময়ই মোবাইল বা কম্পিউটারে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকতে পারছে। বিশ্বের তথ্যভাণ্ডারের সাথে সার্বক্ষণিকভাবে বা প্রয়োজনে সংযুক্ত থেকে তথ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য কানেকটিভিটি মূল ভূমিকা পালন করে। ব্রডকাস্টিং, টেলিকমিউনিকেশন এবং ইন্টারনেট কানেটিভিটির মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।
(ঘ) ডেটা :
ডেটা হলো সাজানো নয় এমন কিছু বিশৃঙ্খল সংখ্যা, শব্দ বা উপাত্ত। ডেটাকে প্রসেসিং বা প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমেই ব্যবহারযোগ্য ইনফরমেশন বা তথ্যে পরিণত করা হয়। বিশ্বগ্রামে বসবাস করতে প্রয়োজন বিভিন্ন তথ্য যা ডেটা থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রসেসিং করে পাওয়া যায়। বিশ্বগ্রামে ডেটা ও তথ্যকে মানুষের প্রয়োজনে একে অপরের সাথে বিনামূল্যে বা অর্থের বিনিময়ে শেয়ার করতে হয় ।
(ঙ) মানুষের সক্ষমতা :
বিশ্বগ্রামের উপাদানগুলোর মধ্যে মানুষের সক্ষমতা অন্যতম। যেহেতু বিশ্বগ্রাম মূলত তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর তাই তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে মানুষের সচেতনতা, স্বাক্ষরতা ও সক্ষমতা ইত্যাদির ওপর এর প্রয়োগ নির্ভর করছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অবকাঠামো ব্যবহার করার জ্ঞান না থাকলে এর সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া যেকোনো বিষয়ে জ্ঞান আহরণ বা বিতরণের জন্য এই প্রযুক্তিতে মানুষের সক্ষমতা প্রয়োজন।
বিশ্বগ্রাম ধারণা সংশ্লিষ্ট প্রধান উপাদানসমূহ
বিশ্বগ্রাম বা গ্লোবাল ভিলেজ ধারণা সংশ্লিষ্ট প্রধান উপাদানগুলো নিচে আলোচনা করা হলো
১। রেডিও (Radio) :
ওয়েভ বা বেতার তরঙ্গ ১০ কিলোহার্টজ থেকে ১ গিগা হার্টজের মধ্যে সীমিত ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্প্রেকটার্মকে বলা হয় রেডিও ওয়েভ। এটা অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে এবং বিল্ডিং ভেদ করতে পারে। তাই রেডিও ওয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। স্থানীয়ভাবে সম্প্রচারিত এএম (AM), এফএম (FM), আন্তর্জাতিকভাবে সম্প্রচারিত শর্টওয়েভ তর শোনা যায়। দেশীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং বিদেশি অনুষ্ঠান বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, ডয়চে ভেলে, রেডিও চায় ইত্যাদিসহ আরও কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার রেডিও সার্ভিসের মাধ্যমে যে কোনো স্থানের লোকজন তাৎক্ষণিকভাবে আবহাও খবরসহ সকল খবরাখবর পাচ্ছেন। গ্লোবাল ভিলেজ তৈরিতে এ উপাদানটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
২। টেলিভিশন (Television) :
টেলিভিশন আবিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্বটাকে গ্লোবাল ভিলেজে রূপান্তর করার প্রচেষ্টা আরও এক ধাপ এগিয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্যাটেলাইট স্থাপনের ফলে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের অসংখ্য চ্যানেল আমরা দেখতে পাচ্ছি। এতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক খবরাখবর, বিভিন্ন সমাজের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিভিন্ন ক্রীড়া অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আমরা ঘরে বসে দেখতে পাচ্ছি। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সমাজের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার ফলে পৃথিবীটা এখন গ্লোবাল ভিলেজে রূপায়িত হয়েছে।
৩। টেরেস্ট্রিয়াল মাইক্রোওয়েভ (Terrestrial microwave):
এ ধরনের প্রযুক্তিতে ভূপৃষ্ঠেই ট্রান্সমিটার ও রিসিভার বসানো হয়। সিগনাল কোনোক্রমেই উঁচু ভবন ও পাহাড় অতিক্রম করতে পারে না বা বক্রপথে যেতে পারে না। তাই প্রেরক ও গ্রাহকের মধ্যে কোনো বাধা থাকলে সংকেত পাঠানো যায় না। এজন্য মাইক্রোওয়েভ এন্টিনা উঁচু কোনো ভবন বা উঁচু টাওয়ারের ওপর বসানো হয়।
৪। স্যাটেলাইট মাইক্রোওয়েভ (Satellite microwave):
স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ উদ্ভব হওয়ায় দূরবর্তী স্থানের খবরাখবর সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। স্যাটেলাইটের মৌলিক উপাদানগুলো হলো : প্রাপক, প্রেরক, ট্রান্সমিটার এন্টিনা, পাওয়ার ইত্যাদি।
৫। ইন্টারনেট (Internet):
ইন্টারনেট হলো গ্লোবাল ভিলেজ প্রতিষ্ঠার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মূলত ইন্টারনেটের কারণে বিশ্বব্যাপী তথ্য আদান-প্রদান সহজতর হয়ে উঠেছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে আমরা যে সেবাগুলো পেয়ে থাকি তা হলো ই- মেইল, ভিডিও কনফারেন্সিং, টেলিকনফারেন্সিং, টেলিমেডিসিন, ই-কমার্স, ই-লানিং, ক্লাউড কম্পিউটিং, অনলাইন টিভি, রেডিও, ডিজিটাল খবরের কাগজ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন— ফেইসবুক, ইউটিউব, টুইটার ইত্যাদি। ইন্টারনেটের কল্যাণে বিশ্ব আজ হাতের মুঠোয়।
৬। টেলিফোন ও মোবাইল ফোন (Telephone and mobile phone):
টেলিফোনের মাধ্যমে টেলিকনফারেন্সিং করা যায়। ছবি না দেখে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। স্মার্টফোন বা থ্রিজি (3G) মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ভিডিও কনফারেন্সিং করা যায়। ফলে ছবি দেখে একে অপরের সাথে কথা বলতে পারে এবং ভিডিও কলও করতে পারে।
টেলিফোন ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এক স্থানের বা দেশের লোকের সাথে অন্য স্থানের বা দেশের লোকের একটি সামাজিক বন্ধন তৈরি হয়েছে এবং গড়ে উঠেছে বিশ্বগ্রাম।
আরও পড়ুনঃ কম্পিউটার কি ও তার কাজ কি?