অপারেশন সার্চলাইট কি? অপারেশন সার্চলাইটের
মূল পরিকল্পনাকারী কে ছিলেন?
অপারেশন সার্চলাইট (Operation
Searchlight) ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত
পরিকল্পিত গণহত্যা, যার মধ্যমে তারা ১৯৭১ এর মার্চ ও এর পূর্ববর্তী সময়ে সংঘটিত বাঙালি
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল।
এই গণহত্যা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের আদেশে পরিচালিত হয়, যা ১৯৭০ এর নভেম্বরে সংঘটিত অপারেশন ব্লিটজ্ এর পরবর্তী অনুষঙ্গ। অপারেশন সার্চলাইটের মূল নকশাকারী ছিল কুখ্যাত জেনারেল টিক্কা খান।
জেনারেল টিক্কা খান (১৯১৫-২০০২) অপারেশন সার্চলাইটের মূল পরিকল্পনাকারী। তিতি ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দমনের জন্য ঢাকায় নির্মম ও বর্বর সামরিক অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চালানোর জন্য তিনি 'বাংলাদেশের কসাই' নামে পরিচিত ছিলেন।
টিক্কা খান ১৯১৫ সালে পাঞ্জাবের কাহুতা
তহসিলের অন্তর্গত জোছা মামদোত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দেরাদুনের ভারতীয় মিলিটারি একাডেমি
থেকে স্নাতক হওয়ার পর তিনি ১৯৩৯ সালে কমিশন লাভ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মা
এবং সাহারায় যুদ্ধ করে তিনি ১৯৪৬ সালে একজন প্রশিক্ষক হিসেবে মিলিটারি একাডেমিতে ফিরে
আসেন। ১৯৪৯ সালে কুয়েটার কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ থেকে ডিগ্রি অর্জনের পর তাকে একটি
আর্টিলারি রেজিমেন্টের কমান্ডার করা হয়। ১৯৬২ সালে তিনি মেজর জেনারেল পদে এবং ১৯৬৯
সালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়, টিক্কা
খানকে পূর্বাঞ্চলের কমান্ড থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার
পর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো তাকে জেনারেল পদে উন্নীত
করেন এবং ১৯৭২ সালের ৩ মার্চ তাঁকে সেনাপ্রধান করেন।
অপারেশনটির আসল উদ্দেশ্য ছিল ২৬ মার্চ
এর মধ্যে সব বড় বড় শহর দখল করে নেয়া এবং রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধীদের এক মাসের ভেতর
নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। কিন্তু বাঙালিরা তখন
পাল্টা প্রতিরোধ সৃষ্টি করে, যা পাকিস্তানি পরিকল্পনাকারীদের ধারণার বাইরে ছিল।১৯৭১
সালের মে এর মাঝামাঝি সময়ে সকল বড় বড় শহরের পতন ঘটার মধ্যে দিয়ে অপারেশন সার্চলাইটের
প্রধান অংশ শেষ হয় ।
এই সামরিক আক্রমণ ১৯৭১ এর গণহত্যাকে ত্বরান্বিত
করে । এই গণহত্যা বাঙালিদের ক্রুদ্ধ করে তোলে যে কারণে পাকিস্তান সেনবাহিনীর বাঙালি
সেনাপতি ও সৈনিকেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয় এবং বহু মানুষকে
শরণার্থীরূপে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়। এই ভয়াবহ গণহত্যা ১৯৭১ এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের
সূত্রপাত ঘটায় এবং বাঙালিরা দখলদারী পাকিস্তানি বাহিনীকে বিতারিত করার সংগ্রামে লিপ্ত
হয়।
পাকিস্তানিদের কৌশল ছিল যে, যেহেতু সেনাবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যদের মধ্যেও আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন রয়েছে, তাই এ অভিযান অত্যন্ত চাতুর্য, চমক, ছল ও গতির সাথে সম্পন্ন করতে হবে। সমগ্র প্রদেশে একই সময়ে অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
উচ্চতর পর্যায়ে, রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ
করা হয়েছিল তিনি যাতে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার সদিচ্ছা ব্যক্ত করেন, এমনকি মুজিবকে
এ বলেও ধোঁকা দেয়া যেতে পারে যে ভুট্টোর অমত সত্ত্বেও ২৫ মার্চ রাষ্ট্রপতি আওয়ামী
লীগের দাবি মেনে নিয়ে ঘোষণা দেবেন।
গণহত্যার খবর যেন বিশ্বে প্রচার না পায়, সে উদ্দেশ্যে ২৫ মার্চের আগে একে একে সব বিদেশি সাংবাদিকদের পূর্ব-পাকিস্তান থেকে বের করে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
গণহত্যার মূল টার্গেট ছিল- বাঙালি ছাত্র,
শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকোশলী, আইনজীবী, আন্দোলনকারী, পুলিশ-ইপিআর-সামরিক বাহিনীর সদস্য।
রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলো দিয়ে সূচনা
হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি-নিধন কর্মসূচি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ছিল পাকিস্তানি
আর্মির বিশেষ টার্গেট। বিশেষ করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ছাত্রদের হল জগন্নাথ
হলকে পুরোপুরি মৃত্যুপুরী বানানোর পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানিদের। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল
অনুসারে, অপারেশান সার্চলাইটের শুরু হবার কয়েক ঘণ্টার মাঝে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা,
খুলনাসহ সারাদেশে পাকিস্তান আর্মি ৫৮,০০০ বাঙালি হত্যা করে।
অপারেশন সার্চ লাইট ও স্বাধীনতার ঘোষণা
নিউইয়র্ক টাইমসের
সাংবাদিক সিডনি শানবার্গ পাকিস্তানের জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালির মন্তব্য উদ্ধৃতি
করে ২৮ মার্চ সানডে টাইমসকে লেখেন-
“সেনাবাহিনীকে যখন ডাকা হবে, সেটাই হবে চূড়ান্ত পদক্ষেপ, সেনাবাহিনী
হত্যার উদ্দেশ্যেই গুলি ছুঁড়বে.’’
পূর্ব পাকিস্তান
সফর শেষে এপ্রিলের ২৮ তারিখে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস সানডে টাইমস এর অফিসে গিয়ে বলেন-
“পূর্ব পাকিস্তানে সত্যিকার অর্থে কী ঘটেছে তা লিখতে চাই, তবে তার পূর্বে
আমার ৫ সন্তান ও স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে হবে।”
এখান থেকেই
ঐ রাতের হামলার ভয়াবহতা সম্পর্কে জানা যায় । অপারেশন সার্চ লাইট এ নগ্ন হামলায় ঢাকা
সহ সব বিভাগীয় শহরে প্রায় ৫০০০০ (পঞ্চাশ হাজার) বাঙালি শহীদ হন।
অপারেশন সার্চলাইটের কতিপয় শহীদ/ DU এর কতিপয় ছাত্র :
১. উপেন্দ্র
নাথ রায়,
২. নির্মল কুমার
রায়,
৩. বিমল চন্দ্র.
৪. অজিত রায়,
৫. সুজিত দত্ত
অপারেশন সার্চলাইটে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এর ১০ (দশ জন শিক্ষক নিহত হন। তাদের মধ্যে ছিলেন-
১. আনোয়ার
পাশা (ইংরেজি)
২. প্রফেসর
রফিকুল ইসলাম (বাংলা)
৩. আব্দুল মুকতাদির
(ভূ-তত্ত্ব)
৪. রাশিদুল
হাসান ।
অপারেশন সার্চলাইটের
পূর্ব নাম কী ছিল?
উত্তর : অপারেশন
ব্রিজ
অপারেশনের পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সকল বিদেশী সাংবাদিককে সরিয়ে দেয়া হয় কিন্তু সাংবাদিক সায়মন ড্রিং থেকে যান গোপনে। সাহসী এই সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গোপনে রাতের হত্যাকাণ্ডের ছবি তোলেন এবং ওয়াশিংটন পোস্ট এর মাধ্যমে বিশ্বকে জানিয়ে দেন । বুয়েটের অধ্যাপক ড. নুরুল উল্লাহ ক্যামেরায় জগন্নাথ হল ও ইকবাল হল (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এ নগ্ন হামলার ছবি তোলেন ।
অপারেশনে যখন ঢাকার মানুষ দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে, তখন বঙ্গবন্ধু বাত ১২.২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন।
" ইহাই
হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেে জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি,যে
যেখানে আছ, যাহার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও। সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে
প্রতিরোধ কর। পাকিস্তান দখল বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হতে বিতাড়িত না করা
পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও ।"