পালবংশের শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে দেবপালের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর
ভূমিকা : প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে পালবংশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাসক ছিলেন দেবপাল। তিনি তার পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে যে সাম্রাজ্য পেয়েছিলেন তাহা সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে সাম্রাজ্যর সীমানা আরও বৃদ্ধি করেন ।
দেবপালের রাজত্বকালে পাল সাম্রাজ্যের সীমানা সবচেয়ে
বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং এ সীমানা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। দেবপালকে উত্তর ভারতের
উত্তরাধিকারী বলা হয়। সাম্রাজ্য বিস্তারের দিক থেকে বিচার করলে দেবপালকে পালবংশের
সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা বলা যায়। কারণ তার বিজয় অভিযান তাকে উত্তর-পশ্চিমে কম্বোজ এবং দক্ষিণে
বিন্দ্য পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল।
দেবপালের পরিচয়
:
মুঙ্গের তাম্রশাসন থেকে আমরা জানতে পারি যে, দেবপাল
ছিলেন রাজা ধর্মপালের পুত্র। তার মাতার নাম ছিল রন্নাদেবী। তার পিতার সমস্ত গুণাবলি
তার মধ্যে ছিল।
সিংহাসনে আরোহণ :
পিতা ধর্মপালের
মৃত্যুর পর আনুমানিক ৮২১ খ্রিষ্টাব্দে দেবপাল বাংলার সিংহাসনে বসেন। তিনি শুধু তার
পিতার রাজ্যকেই রক্ষা করেননি; বরং তিনি এ সাম্রাজ্যকে আরও বিস্তৃত করেন বহুদূর পর্যন্ত।
তিনি যখন সিংহাসনে বসেন তখন বাংলায় শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছিল।
দেবপালের কৃতিত্ব :
পালবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ
রাজা ধর্মপাল | কিন্তু সার্বিক দিক থেকে হিসাব করলে দেবপাল ছিল ধর্মপালের অনেক ঊর্ধ্বে।
নিম্নে দেবপালের কৃতিত্বসমূহ আলোচনা করা হলো
:
১. সামরিক অভিযান :
মুঙ্গের তাম্রশাসন, নারায়ণপালের ভাগলপুর তাম্রশাসন
এবং বাদল প্রশস্তিলিপি থেকে আমরা দেবপালের সামরিক অভিযান সম্পর্কে জানতে পারি যে, দেবপাল
তার হস্তিবাহিনী নিয়ে সিন্ধু পর্বত জয় করার পর কম্বোজ অধিকার করেন।
তিনি উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে বিন্দ্য পর্বত
পর্যন্ত তার রাজ্য বিস্তার করেন। বাদল প্রশস্তিলিপিতে বলা হয়েছে যে, তার মন্ত্রীরা
ব্রাহ্মণ ছিলেন। তার প্রথম মন্ত্রীর নাম ছিল দর্ভপানি।
দেবপালের রাজ্য জয় :
দেবপাল সিংহাসনে
আরোহণ করে পিতার নীতি অনুসরণ করে সাম্রাজ্য বিস্তারে সচেষ্ট হন। নিম্নে দেবপালের বিভিন্ন
রাজ্য জয় সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
১. উড়িষ্যা জয় :
বাদল প্রশস্তলিপি
থেকে আমরা দেবপালের উড়িষ্যা জয় সম্পর্কে জানতে পারি। এ লিপি থেকে জানা যায় উড়িষ্যায়
তিনি তার সামরিক অভিযান চালিয়েছিলেন। "Ancient History of Bengal" গ্রন্থে ড.
আর সি মজুমদার বলেছেন যে, দেবপাল সম্ভবত একাধিক বার উড়িষ্যা আক্রমণ করেছিলেন।
কিন্তু তিনি
কখন উড়িষ্যা জয় করেছিলেন কিনা তা সঠিকভাবে বলা যায় না। তবে খুব সম্ভবত ভঞ্জ বংশীয়
রাজা রণভঞ্জের পরবর্তী কোনো এক সময়ে তিনি উড়িষ্যা দখল করে ছিলেন।
২. দ্রাবিড় রাজ্য জয় :
মুঙ্গের তাম্রলিপি
থেকে জানা যায় যে দেবপাল দ্রাবিড় রাজ্যর দর্পচূর্ণ করেছিলেন। তিনি দ্রাবির রাজ্যর
শ্রী মারা শ্রী বল্লভকে পরাজিত করেছিলেন। তবে এই দ্রাবিড় রাজ্যে নিয়ে ঐতিহাসিকদের
মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
অনেকে মনে করেন
যে, দ্রাবিড় বলতে রাষ্ট্রকূট রাজ্যকে বুঝায়। ড. রামচন্দ্র মজুমদার এ মত মানতে রাজি
হননি। তিনি দ্রাবিড় রাজ্য বলতে দাক্ষিণাত্যেকে বুঝাননি। তিনি বলেছেন যে, দ্রাবিড়
বলতে কৃষক নদীর দক্ষিণাস্থিত ভূ-ভাগকে বুঝিয়েছেন ।
৩. প্রাগজ্যোতিষ
জয় :
প্রাগজ্যোতিষ ব্রহ্মাপুত্রদের একটি উপত্যকার নাম। এটি একটি রাজ্যও বটে। এ রাজ্যের রাজা ছিলেন প্রলম্ব ও তার ছেলে হররাজ কথিত আছে যে, রাজা উলম্ব ও তার পুত্র হররাজ গৌড়ের সেনাপতি জনালের নাম শুনে যুদ্ধনীতি ত্যাগ করেন এবং পাল রাজাদের আনুগত্য প্রদর্শন করতে শুরু করেন। দেবপাল আসাম রাজ্য জয় করেছিলেন। এই তাম্রশাসনের বিবরণে দেখা যায় যে, দেবপাল আসাম রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে বিশেষ সাফল্য লাভ করেন।
৪. আসাম জয়ঃ
তিনি আসাম রাজ্য
জয় করেছিলেন কি-না তা সঠিকভাবে বলা যায় না। দেবপাল জয় পালকে আসাম সীমান্তে আক্রমনের আনার নির্দেশ দেন। ধারণা
করা হয় যে, আসামের শাসকের সাথে দেবপালের মধ্যে চুক্তি হয় এবং আসামের শাসক দেবপালের
বশ্যতা স্বীকার করেন।
৫. কম্বোজ জয়ঃ
দেবপাল হয়তো
কম্বোজ অভিযান করেছিলেন। এ সময় এখানে শাহী নামক রাজবংশ রাজত্ব করত। তিনি এটি জয় করেন।
৬. হনরাজ্য জয় :
দেবপাল যে হুনজাতির গর্ব খর্ব করেছিল তিনি সঠিকভাবে
বলা যায় না। ষষ্ঠ শতকে হুনজাতি আর্যাবর্তের পশ্চিম ভাগে প্রথম রাজ্য স্থাপন করেছিল। কিন্তু তারা
ক্রমশ হীনবল হয়ে পড়ে এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র
রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েন। সম্ভবত দেবপাল এ রাজ্য জয় করেছিল।
৭. দেবপালের রাজ্যসীমা :
দেবপালের রাজ্যসীমা
নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন যে, সমগ্র উত্তর
ভারত তার সাম্রাজ্যাভুক্ত ছিল। ড. আর. সি. মজুমদারের মতে, দেবপালের রাজ্যসীমা আসাম
থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। উত্তরে হিমালয় থেকে শুরু করে দক্ষিণে সিন্ধু পর্বত
পর্যন্ত কিংবা তার চেয়েও অধিক ভূখণ্ড জুড়ে তার রাজ্যসীমা বিস্তৃত ছিল।
৮. দেবপালের রাজত্বকাল :
তিনি ৩৫ বছর
রাজত্ব করেছেন। লামা তারনাথের মতে, তিনি ৪৫ বছর রাজত্ব করেছিলেন। আমরা তার রাজত্বকালে
একই বংশের ৩ জন মন্ত্রী দেখতে পাই। এর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, তিনি সম্ভবত ৩৫-৪০
বছর বাংলা শাসন করেন।
৯. ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকতা :
দেবপাল বৌদ্ধধর্মের
পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও অন্যান্য ধর্মের প্রতি তার উদার দৃষ্টিভঙ্গি
ছিল। তার ৩ জন মন্ত্রী ছিলেন ব্রাহ্মণ। তার সময় অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও শান্তিতে
বসবাস করতো।
১০. উপাধি গ্রহণ :
দেবপাল তার
কৃতিত্বের পুরুস্কারস্বরূপ পেয়েছেন অনেক উপাধি । তাকে বলা হতো 'পরমেশ্বর, পরমভট্টারক,
মহারাজাধিরাজ।'
১১. শিক্ষা ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতাঃ
তিনি বৌদ্ধধর্মের
বিস্তারের জন্য নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে এতে ব্রাহ্মণ শিক্ষক নিয়োগ দিতে
বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। এছাড়া তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি পথ
তৈরি করেন।
উপসংহারঃ
সম্রাট দেবপাল
তার স্বীয় বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল প্রয়োগ করে বিজিত রাজসমূহে একটি সুষ্ঠু শাসনকাঠামো
গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে সুশাসক ও আইন প্রণেতা। এক কথায়, তিনিই
ছিলেন রাজ্যের সকল ক্ষমতার উৎস। ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।