তাওবাদ কী? প্রাচীন চীনে তাওবাদের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
ভূমিকা:
বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে চীনা সভ্যতা একটি অন্যতম সভ্যতা। সিন্ধু ও মেসোপটেমিয়ার পরেই এ সভ্যতার উদয় হয়েছিল। চৈনিক সমাজে ঐক্য, স্থিতিশীলতা, শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য, সমাজ ও ব্যক্তি জীবনের উন্নতির জন্য কতকগুলো নীতিমালা প্রচার শুরু করেন। এর মধ্যে তাওবাদ অন্যতম। এই অনুচ্ছেদে প্রাচীন চীনে তাওবাদের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হবে।
তাওবাদ কী:
কিংবদন্তি অনুযায়ী খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর চীনের অধিবাসী লাওৎসে নামক এক ব্যক্তি কতকগুলো প্রাকৃতিক নিয়মকে নিজস্ব চিন্তামণ্ডিত করেন। তিনি এই ভাবধারাকে 'তাও' নামে আখ্যা দেন এবং ৮১টি পরিচ্ছদ সংবলিত 'তাও-তে চিঙ' নামক গ্রন্থে এগুলোকে সংকলন করেন। কবিতাময় গভীর আত্মাপলব্ধিপ্রসূত এই সংকলনটি তাওবাদের আদি গ্রন্থ। এই গ্রন্থে লাওৎসে যে ভাবধারা ব্যক্ত করেন তাই তাওবাদ নামে পরিচিত।
তাও শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো, 'যার সাহায্যে কোনো পদার্তের মুখ বা আরন্তে পৌঁছানো যায়। অর্থাৎ মৌলিক অর্থের প্রকৃতির পথ বা মার্গ। এখানে পথ সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত।' তাও হচ্ছে সেই পথ; যার সাহায্যে সবকিছু চালিত বা বাহিত হয়।
তাওবাদের এই পথ বা পারমার্থিক তাত্ত্বিক জ্ঞান উপনিষদের 'ঋত' নামক শব্দের অন্তর্নিহিত ভাবধারার সাথে তুলনা করা যেতে পারে বলে অনেক ভারতীয় গবেষক মত প্রকাশ করেছেন। 'ক্ষত' শব্দের ন্যায় 'তাও' হচ্ছে সেই শাশ্বত সত্য পথ, যার সাহায্যে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আদি ভৌতিক ও আধ্যাত্মিক সবকিছুই চালিত বা বাহিত হয়।
এটি জগৎ ও জাগতিক চেষ্টার অন্তর্নিহিত এক ও অদ্বিতীয় শক্তি। 'তাও' নিজ অব্যক্তরূপে
অনাদি অনন্ত ও অপরিবর্তনীয়। তাওবাদের মূল লক্ষ্য ছিল প্রকৃতি প্রদত্ত সরল ও সহজ নিয়মকানুন
মেনে দীর্ঘ জীবন লাভ করা।
তাওবাদের বৈশিষ্ট্য:
লাওৎসে বর্ণিত তাওবাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১. নৈতিক দর্শন:
লাওৎসের শিক্ষা ছিল পৃথিবীর ন্যায় নীতির স্বছে মানুষের ঐক্য স্থাপনের প্রচেষ্টা। তিনি প্রজার দ্বারা আদর্শ নাজ গঠনের চিন্তা করেন। এ ধরনের সমাজ গঠন বিশৃঙ্খল ও অতিক অবক্ষয়প্রসূত সমাজ থেকে বহুদুরে নির্জন জীবনযাপন দ্বারা খুব। লাওৎসে বলেন, "মানুষের উচিত প্রকৃতির আপন ধারায় একে অগ্রসর হতে দেওয়া এবং মানুষ যদি প্রকৃতির আপন ধারায় শেতে পারে তবেই তার জীবনে স্বার্থকতা আসবে।
লাওৎসে বলেন, 'স্বার্থপরতা হচ্ছে মানুষের অসুখী হওয়ার প্রধান কারণ।" তিনি মানব জীবন থেকে সার্থপরতা উচ্ছেদ করার শিক্ষা দেন। তিনি আরও বলেন যে, প্রকৃতিতে এমন একটি সমাজ গঠন সম্ভব হবে যখন মানুষের সৃষ্ট কোনো কৃত্রিম রীতিনীতি অর্পিত হবে না।
২. শিক্ষা দর্শন:
তাওবাদী লাওৎসের দর্শন ছিল "শিক্ষা
মানুষকে চৌর্যবৃত্তিতে সাহায্য করে।" যারা শিক্ষা দেয় তারা কিছু জানেনা, যারা
জানে তারা শিক্ষা দেয় না। তাই জ্ঞান ও শিক্ষাকে পরিহার করা গেলে মানুষ উপকৃত হবে। তার
মতে, একজন সত্যিকারের পরিপূর্ণ মানুষ সে, যিনি মিতব্যয়ী ও নিরহংকারী। লাওৎসের শিক্ষা
ছিল বিশ্বজনীন শান্তিবাদ। তাঁর উপদেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
ক) বিশ্বজনীন শান্তিবাদ-প্রতিশোধ পরায়ন
না হওয়া।
(খ) প্রেমের মাধ্যমে মানুষে মানুষে প্রীতি
স্থাপন করা।
(গ) সাম্যবাদ-যার অধিক আছে তার কাছ থেকে
যার নেই তাকে দেয়াই স্বর্গীয় নীতি।
ঘ) যার আছে তার কাছ থেকে অন্যকে দান করা।
ঙ) মিতব্যয়ী ও অহংকারমুক্ত হওয়া।
৩. রাষ্ট্র দর্শন:
লাওৎসের তাওবাদী মতবাদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাষ্ট্রদর্শনের শিক্ষা। তাঁর মতে, রাজ্যে সরকারি হস্তক্ষেপ অনাচার বৃদ্ধি করে এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তিনি বিশ্বাস করতেন সরকারি হস্তক্ষেপ অনাচার বৃদ্ধি করে।
সমাজে বাধা-নিষেধ যতো গড়ে তোলা যায়, প্রজারা ততোই নিঃস্ব ও রিক্ত হয়। আইনের সংখ্যা
বাড়লে চোর-ডাকাতের সংখ্যা বাড়ে। কারণ আইন বুদ্ধিমান ব্যক্তির দ্বারা সৃষ্টি হয় এবং
আইনই অপরাধ সৃষ্টি করে। লাওসের মতে, শাসক শ্রেণি চারভাগে বিভক্ত-
(ক) সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক যার অস্তিত্বটুকুই
মানুষ জানে।
(খ) সুশাসক সর্বদা শ্রদ্ধা পান।
(গ) অত্যাচারিত শাসক যার ভয়ে প্রজারা বঞ্চিত।
(ঘ) নিন্দিত শাসকেরা সবসময় প্রজাদের নিন্দা
করে।
জাঁকজমকপ্রিয়, স্বার্থপর রাজপুরুষের তীব্র নিন্দা করেছেন লাওৎসে। অবশ্য তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য রাজতন্ত্রের উল্লেখ করেছেন। তিনি একজন জ্ঞানী ও সদাশয় রাজার কামনা করেন। এ বিষয় তিনি কনফুসিয়াসের সঙ্গে একমত যে, সরকারের প্রধান নীতি হবে জনগণের সুখ-সমৃদ্ধির ব্যবস্থা করা।
যদিও তিনি স্বৈরতন্ত্রের কথা বলেননি তবু একজন ব্যক্তিত্ব
অরাজকতাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তিনি মনে করেন যদি কোথাও কার্যশীল সরকার না থাকে তবে
মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সুখে শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারবে।
লাওৎসের দর্শনের প্রভাব:
লাওৎসের মতবাদের প্রভাব চীনে প্রবলভাবে লক্ষণীয়। তবে অনেকেই আবার লাওৎসের মতবাদের বিরোধী। তাদের মধ্যে ওয়ালব্যাংক ও টেইলর তাওবাদকে "দার্শনিক অরাজকতাবাদ" বলে অভিহিত করেন। রুশোর মতবাদের সঙ্গে লাওৎসের মতবাদ অনেকটা সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। সভ্যতার সূত্রপাত চীনে যে সমাজ চিন্তা চলে আসছিল সেই চিন্তাধারার সঙ্গে তাও দর্শনের সংগতি নেই।
কনফুসিয়াস ছিলেন জীবন দর্শনের অগ্রণী নায়ক। অথচ এ দর্শনের বিপরীত ছিল তাওবাদ। তাও দর্শন পরবর্তীকালে ধর্মের আকার লাভ করে। তাওবাদীদের মধ্যে মন্দির, যাজক ও কুসংস্কার প্রথার প্রচলন ছিল।
চীন বংশের কোনো এক রাজা তার সভাসদের
মধ্যে তাওতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতেন, সভাসদ বর্গের কাছে কেউ হাত তুললে তাকে হত্যা করা হতো।
ভূতপ্রেত বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত আদিম ধর্মানুষ্ঠানের সঙ্গে তাওবাদ মিশে গিয়েছিল।