অপারেশন জ্যাকপট কি
জ্যাকপট শব্দের অর্থ- যতক্ষণ না পর্যন্ত
শহীদ ততক্ষণ পর্যন্ত ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নৌ-সেক্টর পরিচালিত গেরিলা অপারেশন হলো অপারেশন জ্যাকপট । অপারেশন জ্যাকপট ১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর এবং দেশের অভ্যন্তরে আরো কয়েকটি নদী বন্দরে একই সময়ে পরিচালিত হয়।
১০নং সেক্টরের অধীনে ট্রেনিংপ্রাপ্ত নৌ
কমান্ডো যোদ্ধাদের অসীম সাহসিকতার নিদর্শন এই অপারেশন জ্যাকপট। এই গেরিলা অপারেশনে
পাকিস্তানি বাহিনীর অনেকগুলো অস্ত্র ও রসদবাহী জাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও বড় রকমের ক্ষতিগ্রস্ত
হয় । ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজগুলোর মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীকে সাহায্যকারী
অনেকগুলো বিদেশি জাহাজ থাকায় এই অপারেশন বাংলাদেশের যুদ্ধ এবং যোদ্ধাদেরকে সারা বিশ্বে
পরিচিতি পাইয়ে দেয়।
ওসমানীর সিদ্ধান্তে নৌ-কমান্ডো সেক্টর খোলার পর বাছাইকৃত গেরিলাদের ট্রেনিং দেয়ার উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক পলাশীর স্মৃতিসৌধের পাশে ভাগীরথী নদীর তীরে ২৩ মে, ১৯৭১ তারিখে একটি গোপন ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়। এই ট্রেনিং ক্যাম্পের সাংকেতিক নাম দেয়া হয় সি-২ পি (C-2 P)। এখানে ট্রেনিং দেয়ার উদ্দেশ্যে অন্যান্য সেক্টরসমূহের বিভিন্ন শিবির থেকে মে মাসের শুরুর দিকে প্রায় ৩০০ জন বাছাইকৃত যোদ্ধা সংগ্রহ করা হয়।
ট্রেনিং ক্যাম্পে এদের কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে সে বিষয়টি এতই গোপনীয় ছিল যে, সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যেও শুধুমাত্র যার এলাকায় অপারেশন চালানো হবে তারা ব্যতীত আর কেউ এই সম্পর্কে জানতেন না।
ট্রেনিং শুরু হবার আগেই বাছাইকৃত যোদ্ধাদের বলে দেয়া
হয় যে, এটি একটি 'Suicidal Operation' বা আত্মঘাতী যুদ্ধ হবে। তাই অপারেশনের সময়
যেকোন মূল্যে অপারেশন সফল করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনে তাদের প্রাণ দিতে হতে পারে।
ট্রেনিং এর দুটো অংশ ছিল। সবাইকে প্রয়োজনীয়
স্থলযুদ্ধ যেমন- গ্রেনেড নিক্ষেপ, এক্সপ্লোসিভের ব্যবহার, স্টেনগান রিভলবার চালানো,
আন-আর্মড কমব্যাট (খালি হাতে যুদ্ধ) ইত্যাদি শিখতে হতো।
আর জলযুদ্ধের ট্রেনিং এর মধ্যে ছিল- বিভিন্ন ধরনের সাঁতার যেমন- বুকে ৫-৬ কেজি ওজনের পাথর বেধে সাঁতার, চিৎ সাঁতার, কোন মতে পানির উপরে নাক ভাসিয়ে একটানা অনেকক্ষণ সাঁতার, পানিতে সাঁতরিয়ে এবং ডুব সাঁতার দিয়ে লিম্পেট মাইন ব্যবহার, স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার, জাহাজের ক্যাবল ভাঙ্গা ইত্যাদি কঠিন সব প্রশিক্ষণ দেয়া হত তীব্র খরস্রোতা ভাগীরথী নদীতে।
যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের শেষদিকে এসে আক্রমণের পরিকল্পনা সাজানো হতে থাকে। একই সাথে একই সময়ে দুই সমুদ্র বন্দর ও দুই নদী বন্দরে আক্রমণ চালানোর জন্য চার সেক্টরের পরিকল্পনার সমন্বয় ঘটানো হয় ।
এই অপারেশনের সংকেত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানের মাধ্যমে যোদ্ধাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল। যা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। এভাবে অপারেশন জ্যাকপট সম্পর্ণ করে মুক্তিযুদ্ধে শক্ত অবস্থান লাভ করে বাংলাদেশ। অপরিসীম সাহস প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্জিত হয় বাংলাদেশ স্বাধীনতা।
২৩ মে ভাগীরথী
নদীর তীরে পলাশীর প্রান্তরে C-2P নামে একটি গোপন ট্রেনিং চালু হয়। ২৮ জুলাই তারিখে
ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং এর নেতৃত্বে জ্যাকপট এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা
হয় । ট্রেনিং শেষে চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশন জ্যাকপট চালানোর জন্য ৬০ জন নৌ কমান্ডোকে
তিনটি গ্রুপে ভাগ করা হয় । প্রত্যেক কমান্ডোকে দেওয়া হয়-
১. লিমপেট মাইন,
২. ছুরি,
৩. একজোড়া
সাঁতারের ফিন,
৪. প্রতি ৩
জনের জন্য একটি স্টেনগান ।
গ্রুপ লিডার A. W. চৌধুরীর জন্য ছিল একটি রেডিও। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে সদস্যরা চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে । পূর্বের পরিকল্পনা মতো ১৪ তারিখ নৌ কমান্ডোদের জন্য “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র" থেকে গান পরিবেশন করা হয়।এর সংকেত ছিল অপারেশনের জন্য তৈরি হও।
“আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম যত গান, তার বদলে চাই প্রতিদান"
১৫ আগস্ট দলনেতার
জন্য প্রচারিত হয় একটি গান-
“আমার পুতুল আজকে যাবে প্রথম শ্বশুর
বাড়ি"
১৪ আগস্ট দিনের পর রাত ১ টা ৪০ মিনিটে জাহাজগুলো প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এম.ভি হরমুজ,
এম.ভি. আল-আব্বাস, ও ওরিয়েন্ট বার্জ সহ ৪৩টি গোলাবারুদ ও অস্ত্রবোঝাই জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায়।
'অপারেশন জ্যাকপট' এর পর তদন্ত রিপোর্টে পাকিস্তান
সেনাবাহিনী উল্লেখ করেছিল- "এ ধরনের ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি এবং গেরিলারা এমন ধরনের
অভিযান চালাতে পারে তা তারা কেউ চিন্তা করেনি।”
প্রশ্ন : আমাদের
মুক্তিযুদ্ধ কেন ত্বরান্বিত হয়েছিল?
উত্তর : অপারেশন
জ্যাকপট-এর সফলতার কারণে। (৪৩টি গোলাবারুদ ও অস্ত্রবোঝাই জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায়)