জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা দিন। জাতীয়তাবাদের উপাদান কি কি

জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা দিন। জাতীয়তাবাদের উপাদান কি কি

জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা দিন। জাতীয়তাবাদের উপাদান কি কি

ভূমিকা : 

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বরাজনীতিতে যে পরিবর্তনের হাওয়া লাগে তার পেছনে মূল কারণ ছিল দেশে দেশে জাতীয়তাবাদের উত্থান। আর এর ফলেই আমরা প্রত্যক্ষ করি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বিভিন্ন জাতি স্বাধীন হতে থাকে এবং জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হতে থাকে। তাই সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও জাতীয়তাবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

 

ওয়াল্টার শার্প এবং গ্রেসন ক্লার্ক তাই মন্তব্য করেছেন যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি অধ্যয়নকারীদের পক্ষে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে ধারণা লাভ করা একান্ত পক্ষেই অপরিহার্য। রাষ্ট্রনেতারা জাতীয় স্বার্থকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়রূপে গণ্য করেন। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যকে অন্য সব আনুগত্যের উপর স্থান দেয়া হয়। কখনও কখনও নীতিবোধ ও ধর্মের প্রভাবের সীমানাকেও অতিক্রম করে জাতীয়তাবাদ অগ্রসর হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় ।

 

জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা : 

সাধারণভাবে বলা যায়, জাতীয়তাবাদ হলো জাতীয় ঐক্যানুভূতি । বিভিন্ন কারণে একই জাতির মধ্যে যে ঐক্যবদ্ধতা লক্ষ করা যায় তাকেই জাতীয়তাবাদ বলে ।


অধ্যাপক লাস্কির মতে, জাতীয়তাবাদ সাধারণভাবে মানসিকতার ব্যাপার; যারা এর অংশীদার, ঐক্যবোধ তাদেরকে বাকি মানবসমাজ থেকে স্বতন্ত্ররূপে চিহ্নিত করে ।


আরনল্ড ডো টয়েনবির মতে, জাতীয়তাবাদ কোনোরূপ বস্তুগত বা যান্ত্রিক কিছু নয় বরং তা জীবন্ত মানুষের এক আত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক অনুভূতি ।


আবার অধ্যাপক স্লাইডারের (LL. Slyder) মতে, জাতীয়তাবাদ ইতিহাসের এক বিশেষ পর্যায়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার ফলাফল। একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনসাধারণের মানসিকতা, অনুভূতি ও চিন্তা চেতনার ফল।'

 

জাতীয়তাবাদ এমন একটি বিশ্বাস বা রাজনৈতিক মতাদর্শ যা মানুষকে একটি রাষ্ট্রের সাথে একীভূত করে। এ মতবাদ জাতীয় পরিচয়ের সাথে সম্পর্কীত এবং ব্যক্তি রাষ্ট্রের কাজ ও সিদ্ধান্তে সমর্থন দিবে। অধ্যাপক লাস্কির মতে, জাতীয়তাবাদ সাধারণভাবে মানসিকতার ব্যাপার, যারা এর অংশীদার, ঐক্যবোধ তাদেরকে বাকি মানবসমাজ থেকে স্বতন্ত্ররূপে চিহ্নিত করে। জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ জনসমষ্টি তাদেরকে পৃথিবীর অন্য সব জনসমষ্টি থেকে পৃথক করে দেখে। এটা কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনসমষ্টির সচেতনতার ফল ।

 

জাতীয়তাবাদের উপাদান :

একাধিক শক্তি বা উপাদান পারস্পরিক ক্রিয়ার মাধ্যমে কোনো জনসমাজকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। আর এসব শক্তিকে জাতীয়তাবাদের উপাদান হিসেবে অভিহিত করা হয়। জাতীয়তাবাদের উপাদানসমূহ প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত। যথা-

 ক. বাহ্যিক ও

 খ. ভাবগত ।


ক. বাহ্যিক উপাদান : জাতীয়তাবাদ গঠনের বাহ্যিক উপাদানগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. ভৌগোলিক ঐক্যঃ

 জাতীয়তাবাদ গঠনের অন্যতম প্রধান উপাদান ভৌগোলিক ঐক্য। একই ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে বহুদিন ধরে বেশ কিছুসংখ্যক মানুষ একত্রে বসবাস করতে থাকলে অধিবাসীদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এক গভীর একাত্মবোধের সৃষ্টি হয়। আবার একই অঞ্চলে বসবাসের ফলে নানা ক্ষেত্রে যোগাযোগ ও আদান-প্রদান সহজতর হয়।

 তার ফলে অধিবাসীদের মধ্যে ঐক্যবোধ জাগ্রত হয়। তবে একথা সব ক্ষেত্রে সমান প্রযোজ্য নাও হতে পারে। ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছিল, কিন্তু এ বিচ্ছিন্নতা তাদের জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করেনি।

 

২. রাজনৈতিক ঐক্য : 

দীর্ঘকাল ধরে কোনো জনসমাজ একই রাজনৈতিক সংস্কৃতির অধীন থাকলে তাদের মধ্যে সহজেই ঐক্যবোধ সৃষ্টি হয়। একই ধরনের রাজনৈতিক ঐক্য অধিবাসীদের মধ্যে একাত্মবোধের সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ দীর্ঘদিন ব্রিটিশ শাসন ভারতবাসীদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে।

 

৩. ধর্মীয় ঐক্য :

 ধর্মীয় ঐক্য জাতীয়তাবাদ গঠনের অন্যতম শক্তিশালী উপাদান। একই ধরনের রীতি-নীতি অনুসরণ, একই ধরনের আধ্যাত্মিক চেতনা মানবসমাজে ঐক্য সৃষ্টি করে, যা জাতীয়তাবাদ গঠনে সহায়তা করে। ভারতবর্ষের মুসলমানগণ ধর্মকে ভিত্তি করে প্রথমে জাতীয় জনসমাজ এবং পরে জাতিতে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান প্রায় সব রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করেছে। একই দেশে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোক বাস করা সত্ত্বেও তারা একই জাতীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ ।

 

৪. বংশগত ঐক্য :

 বংশগত ঐক্য জাতীয়তাবাদ গঠনের অন্যতম উপাদান। কোনো জনসমষ্টি যখন বিশ্বাস করে যে, তাদের শিরা-উপশিরায় একই রক্ত প্রবাহিত এবং তাদের আকৃতিগত বৈশিষ্ট্য অভিন্ন তখন স্বভাবতই তাদের মধ্যে স্বজনপ্রীতি দেখা দেয়। বংশগত এ ঐক্য গভীর জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি করে। যদিও বর্তমানে কোনো দেশই একই বংশীয় লোক দ্বারা গঠিত নয় বরং বিভিন্ন বংশের সমন্বয়ে গঠিত।


৫. ভাষাগত ঐক্য : 

জাতীয়তাবাদ গঠনের ক্ষেত্রে ভাষাগত ঐক্য একটি শক্তিশালী উপাদান। একই ভাষাভাষী জনগণের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান সহজেই হয়। ভাষাগত ঐক্যের কারণে তাদের সাহিত্য, রঙ্গ রসিকতা হয় একই ধরনের। সে জন্য এক ভাষাভাষীরা খুব সহজেই পরস্পরের মনোরাজ্যের পরিচয় পেয়ে একাত্ম হতে পারে।

 ভাষাগত ঐক্য জাতীয়তার এক গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হলেও বহু ভাষাভাষী জনসমষ্টি নিয়েও অনেক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছে। যেমন- বিচিত্র ভাষাভাষী নিয়ে ভারতবর্ষ এবং চারটি ভাষাভাষী (জার্মান, ফরাসি, ইতালিয়ান এবং রোমান) মানুষ নিয়েও সুইস জাতি গঠনে অসুবিধা হয়নি।

 

৬. ঐতিহ্যগত ঐক্য :

সুদূর অতীত থেকেই ঐতিহ্যগত ঐক্য বিভিন্ন জনসমাজের মধ্যে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। সুদীর্ঘকাল ধরে একই ভূখণ্ডে বসবাস করলে জনসমাজের মধ্যে ইতিহাস, কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধনের ফলে ঐতিহ্যগত ঐক্য গড়ে ওঠে। এরূপ ঐতিহ্যগত ঐক্য জাতীয়তাবাদ গঠনে অত্যন্ত সহায়ক উপাদান হিসেবে কাজ করে ।

 

৭. অর্থনৈতিক ঐক্য : 

অর্থনৈতিক ঐক্য জাতীয়তাবাদ গঠনের অন্যতম উপাদান। অর্থনৈতিক সমস্বার্থ জনগণকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। অভিন্ন অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে জনগণ বিপ্লবের শামিল হয়েছে ইতিহাসে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে।

 

৮. জাতীয় চরিত্র ও জাতীয় প্রকৃতি :

 একই ধরনের পরিবেশ, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা, সামাজিক ও আইনগত প্রতিষ্ঠানাদি এক ধরনের গোষ্ঠী ঐক্য গড়ে তোলে। গোষ্ঠী ঐক্য হতে বিবর্তনের মাধ্যমে জাতীয় চরিত্র গঠিত হয়, যা জাতীয়তাবাদ গঠনের ক্ষেত্রে খুবই সহায়ক ভূমিকা পালন করে।


৯. সম্মোহনী নেতৃত্ব :

 কোনো বিশেষ ব্যক্তির সম্মোহনী নেতৃত্ব জনসমাজকে জাতীয়তাবোধে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে জার্মানিদের বংশগত আত্মঅহমিকার সাথে হিটলারের সম্মোহনসুলভ নেতৃত্ব জার্মানবাসীকে প্রচণ্ড জাতীয়তাবোধে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিল।

 

১০. দ্বন্দ্ব ও কলহের মধ্যকার ঐক্যবোধ :

 দ্বন্দ্ব-কলহ নেতিবাচক হলেও তা অনেক সময় জাতীয়তাবাদ গঠনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন সামন্তবাদী ও বংশগত দ্বন্দ্ব-কলহ ইউরোপে জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা বিকাশে প্রভূত সাহায্য করেছিল। অনেক সময় শোষিত জনসাধারণ শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ায়। এসব দ্বন্দ্বের ফলে গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠে, যা জাতীয়তা গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে ।

 

খ.ভাবগত উপাদান :

 রাষ্ট্রের জনসাধারণের মধ্যে ভাবগত ঐক্যের ভিত্তিতেই জনসমাজের মধ্যে জাতীয়তাবোধ গভীরভাবে জাগরিত হতে পারে। অধ্যাপক গেটেল (Gettell) এর মতে, The basis of unity in modern state is psychological rather than physical." আধুনিক রাষ্ট্রের ঐক্যের ভিত্তি বাহ্যিক নয়, সম্পূর্ণ মানসিক।" তিনি আরো বলেন, জাতীয়তা আসলে একটি ভাবগত ব্যাপার, একটি মানসিক অবস্থা; জীবনযাত্রা, চিন্তা এবং অনুভূতির একটি পদ্ধতি। উপরে উল্লিখিত বাহ্যিক উপাদানগুলোর মাধ্যমেই জাতীয়তাবাদের ভাবগত উপাদান গড়ে ওঠে এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে বিশেষ গতি দান করে ।

 

 গ. মার্ক্সবাদীদের ধারণা : 

জাতীয়তাবাদের উপাদান সম্পর্কে মার্ক্সবাদীদের ধারণা ভিন্ন কথা বলে। মার্ক্সীয় দর্শন অনুসারে বাস্তব উপাদানগুলোর অনুপস্থিতিতে জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠা অসম্ভব প্রায়। মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে জাতীয় চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে ভাবগত প্রভাবের থেকে বাস্তব কয়েকটি উপাদানের গুরুত্ব বেশি। মার্ক্সবাদে জাতীয়তাবাদ গঠনে অর্থনীতি সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী উপাদান।

 

জাতীয়তাবাদ জাতীয় জীবনে একটি মহান আদর্শ। এ হলো একটি গভীর অনুপ্রেরণা। জাতীয়তাবাদ জাতিকে ঐক্যবোধে একাত্ম করে এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। এই আদর্শ দেশের ও দশের স্বার্থে আত্মত্যাগে ব্যক্তিকে অনুপ্রাণিত করে। অর্থনীতি, ভাষা, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক অবস্থা, ধর্ম প্রভৃতির জাতীয়তাবাদে কিছু না কিছু অবদান রয়েছে।

 

উপসংহার : 

জাতীয়তাবাদ হলো একটি জাতির চেতনা। জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির মাধ্যমে একটি জাতি- রাষ্ট্র গঠিত হয়। জাতীয়তাবাদ সৃষ্টিতে কোনো না কোনো উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। একটি রাষ্ট্র এক একটি আলাদা উপাদানের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। মোট কথা, হলো একটি মানসিক অনুভূতি ।

 

 


Post a Comment

Previous Post Next Post