হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পরিচয় দাও , Introduce Hajjaz bin Yusuf

হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পরিচয় দাও , Introduce Hajjaz bin Yusuf

হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পরিচয় দাও

উমাইয়া খিলাফতের ইতিহাসে তথা আরব মুসলমানদের ইতিহাসে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর নাম এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।  উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক ও খলিফা আল ওয়ালিদের শাসন সংস্কার ও সাম্রাজ্য বিস্তারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । তিনি উমাইয়া বংশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে গৌরব ও উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে আসেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তার এ কর্মের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

১. পরিচয়:

হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছিলেন আরব প্রশাসক, রাজনীতিবিদ ও উমাইয়া খিলাফতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। তিনি ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে তায়েফে জন্মগ্রহণ করেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক (৬৮৫-৭০৫ খ্রি.) ও ওয়ালিদের (৭০৫-৭১৫ খ্রি.) খিলাফতকালে বিদ্রোহ দমন ও সাম্রাজ্য সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।হাজ্জাজের অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় পেয়ে খলিফা আবদুল মালিক ও ও ওয়ালিদ তাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন ।

২. উমাইয়া বংশের দুর্যোগকালীন মুহূর্তে দায়িত্ব গ্রহণ:

উমাইয়া বংশের শাসক আব্দুল মালিক যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন সিংহাসনের চারদিকে শত্রুবেষ্টিত ছিল। সেসময় আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের হেজাজ, ইরাক, মিসর ও সিরিয়ার কিছু অংশের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে নিজেকে খলিফা বলে ঘোষণা করেন । এছাড়া পারস্যে খারিজি বিদ্রোহ, কুফা ও বসরায় আলির সমর্থকদের বিপ্লব এবং উত্তর আফ্রিকার বার্বার ও রোমান বিদ্রোহ উমাইয়া বংশের অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দেয়। এ সংকটের মুহূর্তে আব্দুল মালিক ৬৯২ খ্রিস্টাব্দে তাকে সর্বপ্রথম আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন । আরাফাতের যুদ্ধে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের পরাজিত ও শহিদ হন। ফলে উমাইয়া খিলাফত সংকট মুক্ত হয় ।

You May also like: আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পটভূমি বর্ণনা কর

৩. পূর্বাঞ্চলের গভর্নর নিয়োগ :

হেজাজ ও ইরাকের শাসনকর্তা থাকাকালীন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় প্রদান করেন। খলিফা তার শাসনকার্যে মুগ্ধ হয়ে পূর্বাঞ্চলের (ইরাক, সিজিস্তান, কাবুল, ট্রান্সঅক্সিয়ানা এবং খোরাসান) শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।

৪.বিদ্রোহ দমন :

খলিফা আবদুল মালিকের শাসনামলে সাম্রাজ্যের সর্বত্র বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। কারবালা যুদ্ধের পর ( ৬৮০ খ্রি.) মক্কায় নিজেকে খলিফা ঘোষণাকারী আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর হেজাজ, ইরাক, মিসর এবং সিরিয়ার কিছু অংশের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। পারস্যে খারেজি ও উত্তর আফ্রিকায় বার্বার বিদ্রোহ মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট করে।

এছাড়া রোমান আক্রমণের আশঙ্কা উমাইয়া বংশের অস্তিত্বকে সংকটাপন্ন করে তোলে। এ অবস্থায় আবদুল মালিক ৬৯২ খ্রিষ্টাব্দে হাজ্জাজকে সর্বপ্রথম ইবনে যুবাইরের বিদ্রোহ দমনের জন্য হেজাজে (বর্তমান সৌদি আরবের পশ্চিমাঞ্চল) পাঠান। আরাফাতের যুদ্ধে বিদ্রোহী ইবনে যুবাইর পরাজিত ও নিহত হন । তারপর  তিনি শিয়া এবং খারেজি সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ  দমন করেন । ৭১৪ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি খিলাফতের সমগ্র পূর্বাঞ্চলের শাসক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

৫.সাম্রাজ্যের সীমা বৃদ্ধি:

হাজ্জাজ বিন ইউসুফ শুধু বিদ্রোহ দমন করেই নিরক্ষ্ম হননি, তার সুযোগ্য নেতৃত্বে সেনাপতি ইয়াজিদ বিন মুহাল্লিব ও কুতাইবা বিন মুসলিম মধ্য এশিয়ায় উমাইয়া সাম্রাজ্যের সীমা বর্ধিত করেন। তারই আদেশে সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু ও মুলতান দখল করেন।

৬. শ্রেষ্ঠ বিজেতা :

গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করেই ক্ষান্ত হননি; বরং তিনি একজন শ্রেষ্ঠ সফল বিজেতা হিসেবেও কৃতিত্ব অর্জন করেন। মুহাল্লিব, ইয়াজিদ বিন মুহাল্লাব, কুতায়বা প্রমুখ সেনাপতি তারই সুযোগ্য তত্ত্বাবধানে সাম্রাজ্যের পূর্বদিকে ও মধ্য এশিয়ার বহুদেশ জয় করেন। তার নির্দেশে মুহম্মদ বিন কাসিম ভারতের সিন্ধু ও মুলতান দখল করে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের ভিত্তি স্থাপন করেন ।

You May also like: ইবনে বতুতা কে ছিলেন?

৭. সংস্কারমূলক কার্যক্রম :

শাসন সংস্কারমূলক কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রেও হাজ্জাজ বিন ইউসুফ যথেষ্ট দক্ষতা ও কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। তার পরামর্শে আব্দুল মালিক নবদীক্ষিত মুসলমানদের নিকট থেকে খারাজ ও জিজিয়া কর আদায় করে রাজ্যের আয় বৃদ্ধি করেন। তিনি কৃষিকাজের প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। কৃষকদের অগ্রিম কৃষিঋণ প্রদান করেন। তিনি আরবি বর্ণমালার সংস্কার সাধন করেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ প্রথম আরবিতে হরকত ও নুকতা ব্যবহার রীতির প্রচলন করেন। 

ফলে আরবি ভাষার উৎকর্ষ সাধিত হয়। তিনি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার করেন। রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য নতুন কর ও খাজনা ধার্য করেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিক্ষা সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার শাসনামলে বহু পণ্ডিত ও জ্ঞানীগুণী উমাইয়া খিলাফতকে অলংকৃত করে।

৮.নিষ্ঠুরতাঃ  

কিছু ঐতিহাসিক হাজ্জাজকে দুরাত্মা, নৃশংসতার অবতার এবং আরবদের নিরো' বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি অনেক মদিনাবাসী এবং এমনকি মহানবির (স) জীবিত সাহাবিদের ওপরও অত্যাচার করেছিলেন।  হাজ্জাজ তার শাসনকালে কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে ১,২০,০০০ এবং সৈয়দ আমীর আলির মতে ১,৫০,০০০ লোককে নানা প্রকার অভিযোগে হত্যা করেন। হাজ্জাজের মৃত্যুর সময় ৫০,০০০ নারী ও পুরুষ কারাগারে ছিল।

৯.মৃত্যুঃ

দীর্ঘ ২০ বছর যাবৎ খিলাফতের পূর্বাঞ্চলে অতি দক্ষতার সাথে শাসনকাজ চালানোর পর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ৭১৪ খ্রিষ্টাব্দে ৫৩ বছর বয়সে মারা যান।


পরিশেষে বলা যায় যে, গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছিলেন একজন যোগ্যতাসম্পন্ন প্রশাসক । স্বীয় দক্ষতাবলে তিনি একজন সামান্য শিক্ষক থেকে উমাইয়াদের একজন শ্রেষ্ঠ প্রাদেশিক গভর্নরের পদে সমাসীন হন। যদিও তিনি নিষ্ঠুর প্রকৃতির শাসক ছিলেন, তথাপি সাম্রাজ্য বিস্তার ও শাসন শৃঙ্খলা আনয়নে উমাইয়া খিলাফতের ইতিহাসে অনন্য ভূমিকা পালন করেন । তাই তাকে উমাইয়া খিলাফতের শ্রেষ্ঠ প্রশাসক বলা হয় । খলিফা আবদুল মালিক  তার উত্তরাধিকারী পুত্র ওয়ালিদকে হাজ্জাজের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন  হাজ্জাজ জগতের বুকে আমাদের নাম রাখতে সক্ষম হয়েছেন। নিষ্ঠুরতার কথা বাদ দিলে ইসলামের ইতিহাসে হাজ্জাব বিন ইউসুফ নিঃসন্দেহে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ।

You May also like: সুলতানা রাজিয়া কীভাবে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন?



2 Comments

Previous Post Next Post