ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের ইতিহাস রচনায় প্রত্নতাত্ত্বিক উৎসের বিবরণ দাও।

 ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের ইতিহাস রচনায় প্রত্নতাত্ত্বিক উৎসের বিবরণ দাও।

ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের ইতিহাস রচনায় প্রত্নতাত্ত্বিক উৎসের বিবরণ দাও।

 

ভূমিকা: মুসলমানদের আগমনের পূর্বে ভারতের কোনো ধারাবাহিক ইতিহাস লেখা হতোনা। মুসলিম বিজয়ের পরেই ধারাবাহিক ইতিহাসে লেখা শুরু হয়। বিখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিক আল বেরুনি বলেন, "হিন্দুরা ঐতিহাসিক রচনার প্রতি উদাসীন।


এখানকার রাজাদের কালানুক্রমিক ইতিহাস সম্পর্কেও অজ্ঞ এবং ঐতিহাসিক তথ্যের জন্য চাপ দিলে এরা কল্পনা ও কিংবদন্তির আশ্রয় গ্রহণ করে" সুলতানি আমলের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অন্যান্য উৎসের ন্যায় প্রত্নতাত্ত্বিক উৎসও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 

ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের ইতিহাস রচনার প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস:


ভারতের মুসলমানদের ইতিহাস জানার জন্য বিভিন্ন উৎসের ওপর নির্ভর করতে হয়। আর এ সমস্ত উৎসের মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস অন্যতম। সুলতানি আমলের ইতিহাস রচনার প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস নিম্নরূপ:

 

১. মুদ্রা :

সুলতানি আমলের বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সামসময়িক মুদ্রার গুরুত্ব অপরিসীম। মুসলিম অধ্যুষিত ও শাসিত অঞ্চলে বহু মুদ্রা পাওয়া গেছে। সুলতানি শাসনামলে ইলতুৎমিশ রৌপ্যমুদ্রা চালু করেন।

 

তিনি প্রথম খাঁটি আরবি রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন করেন যা রূপাইয়া নামে পরিচিত ছিল এবং একটি পরিমাপের রূপাইয়ার ওজন ছিল ১৭৫ মেন। মুদ্রা সংস্কারের ক্ষেত্রে তুঘলক বংশের সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি ভারতবর্ষে প্রথম তাগ্রে মুদ্রা প্রচলন করেন।

 

এ কারণে তাকে মুদ্রা প্রবর্তনকারীদের পথিকৃৎ বলা হয়েছে। মুদ্রা সমকালীন শাসক বংশের ধারাবাহিকতা, রাজ্যের বিস্তৃতি, অর্থনৈতিক অবস্থা, বিশেষত বিভিন্ন রাজার শাসনকালের সন তারিখ জানার ক্ষেত্রে মুদ্রা বিশেষ উপযোগী।

 

মুদ্রার গুরুত্ব বিশ্লেষণ করে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ লেন পুল বলেন, "As a rule we may look upon Muhammadan coins as the surest foundation for an exact history of the dynasties by which they were issued."

 

২. শিলালিপি:


দিল্লির সুলতানি আমলের ইতিহাসের উৎসের অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য উপাদান হচ্ছে শিলালিপি। মুসলিম শাসকদের নির্মিত মসজিদ, মাজার, স্তূপ প্রভৃতি স্থানে পাথর অথবা তাম্রপাতের ওপর উৎকীর্ণ বিভিন্ন তথ্যসমৃদ্ধ শিলালিপি পাওয়া যায়।

 

শিলালিপি উদ্ভাবনের পর সেগুলো পাঠোদ্ধার করে প্রকাশিত হয় Epigraphia Indo Islamica গ্রন্থে। এ ধরনের অপ্রকাশিত শিলালিপি পাঠোদ্ধার করে প্রকাশিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পথিকৃৎ ছিলেন আলেকজান্ডার কানিংহাম, বার্জেস, জেড এ দেশাই, শামসুদ্দিন আহমদ।

 

শিলালিপি আরবি ও ফারসি ভাষায় উৎকীর্ণ হতো। ঐতিহাসিক তথ্যের চেয়ে শিলালিপি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে এগুলো সামসময়িক কাহিনি ও তথ্য সরবরাহই করে না বরা এতে সুলতান ও তার সভাসদ, সেনাপতি, রাজকর্মচারীদের সঠিক নাম, পদবি, প্রাপ্তিস্থান প্রভৃতির উল্লেখ থাকে, যা সুলতানদের রাজত্বকাল নির্ধারণে সহায়তা করে।

 

৩. স্থাপত্যকীর্তি ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন:


সুলতানি আমলের ইতিাস রচনার ক্ষেত্রে সুলতানদের নির্মিত স্থাপত্যকীর্তি ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে সাংস্কৃতিক ও শিল্পকলার উৎকর্ষতার ক্ষেত্রে। সুলতানি আমলে বহু প্রাসাদ, মসজিদ, দুর্গ ইত্যাদি নির্মিত হয়েছিল।

 

কালের গ্রাস উপেক্ষা করে তাদের অনেকগুলো আজও দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যের নির্বাক প্রতীক হিসেবে। সমকালীন সুলতানদের শিল্পভাবনা, শিল্পীদের দক্ষতা এবং সংস্কৃতির ধারা সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে এই সকল নিদর্শনের ইতিহাসগত গুরু গুরুত্ব অসীম।

 

পরিশেষে বলা যায় যে, তৎকালীন ভারতে মুসলমান শাসকের পরিচয় ও তাদের শাসনকাল, ভারতের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করার জন্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপকরণসমূহ অফুরন্ত উৎস হিসেবে কাজ করে। তাই মুসলিম ভারতের ইতিহাসের সঠিক, নির্ভুল ও অভ্রান্ত তথ্য উৎস হিসেবে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মহামূল্যবান।

Post a Comment

Previous Post Next Post