বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কাকে বলে? সামাজিক গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির গুরুত্ব আলোচনা কর ।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কাকে বলে? সামাজিক গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির গুরুত্ব আলোচনা কর 

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কাকে বলে? সামাজিক গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির গুরুত্ব আলোচনা কর ।


 ভূমিকা :  পদ্ধতি বিজ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক মর্যাদা দান করে।  আদিকাল হতে মানুষ তার নিজের সম্বন্ধে, তার পরিবেশ। পারিপার্শ্বিকতা ও সমাজ সম্বন্ধে জানবার, বুঝবার চেষ্টা অব্যাহত রেখে আসছে। "Scientific method is the logic of scientific  investigation." সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্করণ। বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয় হচ্ছে পদ্ধতি বা নিয়মতান্ত্রিকতা। এটি একটি নিয়মতান্ত্রিক সুসংবদ্ধ জ্ঞানভান্ডার। আর এ সুসংবদ্ধ জ্ঞান ভান্ডারকে অর্জন করার লক্ষ্যে একটি সুনির্দিষ্ট পন্থায় অগ্রসর হতে হয়। এ পন্থাই হচ্ছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ।

 

 বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি : কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যেমন- নীতি, বিধি, প্রক্রিয়া, প্রণালি, রীতি বা কার্যবিধি এবং পদ্ধতি ধারণাসমূহের সম্মিলিত নাম পদ্ধতি। সাধারণভাবে বলা যায়, বিজ্ঞানসম্মত অনুসন্ধানসিদ্ধ উপায়ই হলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ।


অন্যভাবে বলা যায়, বিজ্ঞানীগণ যে যৌক্তিক পদ্ধতিতে সামাজিক ও প্রাকৃতিক জগতের বিষয়াবলির পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা- নিরীক্ষা, বর্ণনা, বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা ও সাধারণীকরণের মাধ্যমে নির্ভরযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য সিদ্ধান্তে উপনীত হয় বা সাধারণ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করে থাকেন সাধারণভাবে ঐ পদ্ধতিকেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে।


প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন মনীষী বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাদের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য কয়েকটি সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো :

Adam and Schvaneveldt এর মতে, "Scientific method is nothing more than thinking according to a set of rules." অর্থাৎ, পূর্বনির্ধারিত বিধিবিধান অনুসরণ করে চিন্তা করাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে ।

Encyclopaedia of Britanica এর মতে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সকল বিজ্ঞান গড়ে ওঠে।

G. A. Lundberg বলেছেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হলো তথ্যরাজির এক ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ ও শ্রেণিকরণ ।

উপরিউক্ত সংজ্ঞার আলোকে বলা যায় যে, অনুসন্ধানের কোনো পদ্ধতির মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক অথবা অন্যান্য নিরপেক্ষ এবং সুসংবদ্ধ যে জ্ঞান অর্জিত হয় তাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে ।

 

 সামাজিক গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির গুরুত্ব:


 নিম্নে সামাজিক গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির গুরুত্ব আলোচনা করা হলোঃ

 

১. বাস্তবমুখী তথ্যনির্ভরতা : বিজ্ঞান তার সত্য প্রতিষ্ঠায় বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তথ্যের উপর সর্বাংশে নির্ভরশীল। | সামাজিক গবেষণা ও সামাজিক পরিবেশ থেকে বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তথ্যাবলি সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তে উপনীত হন।


২. প্রাসঙ্গিক ধারণার ব্যবহারঃ  বিজ্ঞান তার অনুসন্ধান কাজে বিশ্লেষণাধীন বিষয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধারণা বিবেচনা ও ব্যবহার করে থাকে। আর এতে করে চিন্তা ও সত্যের ন্যায় স্পর্শ বজায় থাকে। সামাজিক গবেষণা সমাজ সম্পর্কিত যেকোনো বিষয়ের উপর অনুসন্ধান কাজ চালাতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলির প্রভাব বিবেচনার চেষ্টা করে।

 

৩. লক্ষ্যাভিমুখী প্রচেষ্টা : প্রতিটি বিজ্ঞানই তার গবেষণার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করতে তা অর্জনের জন্য চেষ্টা করে। এই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে গবেষণা নির্দিষ্ট বিষয়ে ধারণাকে প্রত্যয়ে পরিণত করে এবং অনুমিত সিদ্ধান্ত গঠন করে তা প্রমাণের চেষ্টা চালায়। অনুমিত সিদ্ধান্ত প্রমাণিত হলে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে সামাজিক গবেষণা ও সামাজিক ক্ষেত্রের বিভিন্ন দিক নির্দিষ্ট করে গবেষণার লক্ষ্য উদ্দেশ্য স্থির করে তা অর্জনের প্রচেষ্টা চালায় ।

 

৪. উদ্দেশ্যমুখী : বিজ্ঞান সবসময়ই সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে এগিয়ে চলে। সামাজিক গবেষণা ও সামাজিক সত্য উন্মোচনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

 

৫. মূল্যবোধ নিরপেক্ষতা : বিজ্ঞান মূল্যবোধ নিরপেক্ষ। বিজ্ঞানে পক্ষপাতিত্বের সুযোগ নেই, তাই বিজ্ঞানীকে সর্বদা মূল্যবোধ নিরপেক্ষ হতে হয়। সামাজিক গবেষণাতে যদিও তা মেনে চলা কঠিন তবে অনুসন্ধানের সময় তা যতদূর সম্ভব মেনে চলার চেষ্টা করা হয়।

 

৬. অভিজ্ঞতা ভিত্তিক জ্ঞান : বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অভিজ্ঞতাভিত্তিক। অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই বিজ্ঞান বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিষয় সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকে। সামাজিক গবেষণা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সামাজিক ঘটনার মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে।

 

৭. সার্বজনীনতা : বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত সার্বজনীন। সামাজিক গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত সামাজিক বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তবলি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান প্রদত্ত সিদ্ধান্তের মতো ততটা সুনিশ্চিত নয়। কেননা, সামাজিক বিষয় অত্যন্ত পরিবর্তনশীল। তাই সামাজিক গবেষণালব্ধ সকল সিদ্ধান্তের বিশ্বজোড়া গ্রহণযোগ্যতা তেমনটা নেই বললেই চলে ।

 

৮. পরিমাপযোগ্যতা : বিজ্ঞানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পরিমাপযোগ্যতা । প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো সামাজিক বিজ্ঞানেও পরিমাপের প্রচেষ্টা চালানো হয়। তবে তা সকল সময় সম্ভব হয় না। এটিকে সামাজিক গবেষণার একটি দুর্বল দিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয় না।

 

৯. প্রাসঙ্গিক ধারণার ব্যবহার : বৈজ্ঞানিক গবেষণার মূল বৈশিষ্ট্য হলো মোটামুটি জানা বা কম জানা বিষয়কে ভালোভাবে জানতে চেষ্টা করা। আর এক্ষেত্রে গবেষণা পরিচালনা করার জন্য জ্যেতিক্রম সমাজবিজ্ঞান l


প্রাসঙ্গিক প্রত্যয় ও ধারণার যথার্থ ব্যবহার করার চেষ্টা করা হয়। সামাজিক গবেষণা ও সমাজ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়কে জানার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক ধারণা ব্যবহার করে গবেষণাকার্যক্রম পরিচালনা করে ।

 

১০. নিয়ন্ত্রণযোগ্যতা : প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো সামাজিক বিজ্ঞানে গবেষণার ক্ষেত্রে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে গবেষণাগারে গবেষণা করা সম্ভব হয় না। তবে এক্ষেত্রে ও যতদূর সম্ভব নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে গবেষণা করার চেষ্টা করা হয়। এ নিয়ন্ত্রণের কৌশল সফলভাবে প্রয়োগের জন্য বিজ্ঞানেও প্রচেষ্টা চালানো হয়।

 

১১. পরিমাপ : বিজ্ঞানের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হলো তার প্রাপ্ত তথ্যের পরিমাপযোগ্যতা। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো সামাজিক গবেষণা তার সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে পরিমাপ করতে পারে না। তবে চুলচেরা পরিমাপ না করতে পারলেও তুলনামূলকভাবে পরিমাপ ও করা সমাজ গবেষকের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে থাকে ।

 

১২. পুনরাবৃত্তি : প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের গবেষণার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বিভিন্ন পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করা সম্ভব কিন্তু সামাজিক বিজ্ঞানে সকল গবেষণার পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয়। তাই এখানে সত্যের পুনরাবৃত্ত করা সব সময় সম্ভব হয় না ।

 

১৩. ভবিষ্যদ্বাণীকরণ : বিজ্ঞানে হিসেবে স্বীকৃত পাওয়ার জন্য এর নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা থাকতে হবে। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে এটা সম্ভব হলেও সামাজিক বিজ্ঞানে তা সম্ভব হয় না। সমাজ গবেষক সামাজিক বিষয় সম্পর্কিত সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভাবনানির্ভর ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকে।

 

উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হলো এমন একটি যুক্তিভিত্তিক ও অনুসন্ধানমূলক প্রক্রিয়া যা সমস্যা চিহ্নিত করে এবং সমাধানের পদ্ধতি নির্দেশ করে এবং একই অবস্থায় বিজ্ঞানীদের দ্বারা সম্পাদিত হলে একই নিয় ফলাফল প্রদানের ক্ষমতা রাখে।

 সামাজিক গবেষণায় বৈজ্ঞানিক সাম পদ্ধতির সকল বৈশিষ্ট্য অনুসরণ বা মেনে চলার চেষ্টা করা হয়। সমাজবিজ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুসারী বলে দাবি করা হয়। যদিও সামাজিক বিজ্ঞানসমূহে ব্যবহৃত বিভিন্ন অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ পদ্ধতির বিচারে সার্বিকভাবে এ দাবি মেনে নেওয়া বেশ কষ্টকর।






 

Post a Comment

Previous Post Next Post