তৈমুর লঙ কে ছিলেন?
ভূমিকা : তৈমুর একজন সাধারণ ঘরের সন্তান ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন অবিরাম
সংগ্রাম করার পর চতুর্দশ শতাব্দীতে একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার শৌর্যবীর্য
ও অসীম দক্ষতার বলে এশিয়ার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজেতা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
১. জন্ম ও বংশপরিচয় : ১৩৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ৯ এপ্রিল তৈমুর সমরকন্দের অদূরবর্তী কেশ নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আমীর তুরঘাই এবং মাতার নাম তাকিনাহ খাতুন। আমীর তুরঘাই তুর্কিদের বারলাস গোত্রের গুরগান শাখার দলপতি ছিলেন। গুরগান শব্দের অর্থ গৌরবময়। ধর্মীয় দিক দিয়ে তার পূর্বপুরুষগণ সামানী বৌদ্ধ ছিলেন। আমীর তুরঘাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন । তৈমুর শব্দের অর্থ লৌহ। তিনি খোড়া ছিলেন বলে নামের সঙ্গে লঙ (খোড়া) শব্দ যোগ করা হয়েছে।
২. প্রাথমিক জীবন : তৈমুর বাল্যকাল থেকে খুব তেজস্বী ও সাহসী ছিলেন।
তিনি মাত্র ১২ বছর বয়সে যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেন এবং বিভিন্ন যুদ্ধে সক্রিয়
অংশগ্রহণ করেন। শৈশব হতেই তার চরিত্রে চাতুর্য, দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার লক্ষণ সুস্পষ্ট
হয়ে ওঠে। চেঙ্গিস খানের ন্যায় তৈমুরও অতি অল্প বয়সে পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু
তার ক্ষমতা লাভের পথ ষ্ঠ কন্টকমুক্ত ছিল না।
তিনি নানা বিপদের সম্মুখীন হাজী বারলাস
যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন। তৈমুর বাধ্য হয়ে তুঘলক তৈমুর খানের নিকট আত্মসমর্পণ
করেন। তৈমুরের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তুঘলক তৈমুর খান তার উপর | ট্রান্সঅক্সিয়ানার শাসনভার
অর্পণ করেন। কিন্তু তার ভাগ্য বেশি দিন সুপ্রসন্ন হয়নি। তৈমুর ষড়যন্ত্রের স্বীকার
হয়ে সমরকন্দ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
৩. ভাগ্যান্বেষী জীবন ও সিংহাসনে আরোহণ :
সমরকন্দ ত্যাগ করে তৈমুর সহায় সম্বলহীনভাবে বিভিন্ন
স্থানে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। ভাগ্য বিপর্যয়ের এই চরম সন্ধিক্ষণে তিনি তার ভগ্নিপতি
ও তুঘলক তৈমুর খান কর্তৃক বিতাড়িত আমীর হুসাইনের সাথে মিলিত হন। তারা দক্ষিণ পারস্য
ভ্রমণকালে সিস্তানের শাসনকর্তা জালালউদ্দিন মাহমুদের সমর্থন লাভ করেন এবং তাদের সহায়তায়
জালালউদ্দিন মাহমুদ বিদ্রোহীদের পরাজিত করে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন।
কিন্তু অকৃতজ্ঞ জালালউদ্দিন মাহমুদ ভবিষ্যতে তৈমুর ও আমীর হুসাইনকে বিপজ্জনক মনে করে আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে তৈমুর সিস্তান সৈন্য বাহিনীর কেন্দ্রস্থল ভেঙে দিতে সক্ষম হলেও তার এক হাত ও এক পা তিরবিদ্ধ হয়। যার দরুন তিনি চিরদিনের জন্য খোঁড়া বা লঙ হয়ে যান। পরবর্তীতে তৈমুর তার সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে উৎখাত করে ১৩৬৯ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং সমরকন্দ তার রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে ।
৪. বিজেতা হিসেবে :
তৈমুর লঙ এশিয়া মহাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ বিজেতা ছিলেন। তিনি একজন সাধারণ
ঘরের সন্ত ভা নি হয়ে রাজ্যজয়, শাসন ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ক্ষেত্রে যে নৈপুণ্য আ দেখিয়েছেন
তা অতুলনীয়। রাজ্যজয়ের ক্ষেত্রে তিনি এশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ বিজেতা ছিলেন।
ঐতিহাসিক পি. সাইকস বলেছেন, “সামান্য একজন
গোত্রপতির পুত্র হয়ে তিনি শুধু সাহসীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সাহসীই ছিলেন না বরং অত্যন্ত
প্রজ্ঞাবান, উদার, বা পারদর্শী ও অধ্যবসায়ীও ছিলেন এবং এসব গুণ তাকে মানুষের প্র অদ্বিতীয়
নেতা ও সর্বজন প্রশংসিত সমরনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।”
৫. শাসক হিসেবে :
শাসক হিসেবে তৈমুর লঙ সত্যনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ছিলেন। তার রাজত্বকালে সাম্রাজ্যে
শান্তি শৃঙ্খলা অব্যাহত ছিল। তার কাছে ধনী গরিবের প্রভেদ ছিল না। এমনকি স্বজনপ্রীতিকেও
তিনি প্রশয় দিতেন না। তিনি শিল্প ও স্থাপত্যের প্রতি যথেষ্ট অনুরাগ প্রদর্শন করেন
তার রাজত্বকালে রাজধানী সমরকন্দে দিলকুশা প্রাসাদ ও জামে মসজিদ তৈমুরীয় স্থাপত্য কীর্তির
নিদর্শন বহন করে। তিনি নিজের জন্য গুর-ই-মীর নামে একটি সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন।
৬. মৃত্যু : দিগবিজয়ী বীর তৈমুর লঙ ১৪০৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।