গজনি সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের উদ্দেশ্যসমূহ বিশ্লেষণ কর।
ভূমিকা:
সুলতান মাহমুদ
৯৯৭ খ্রিঃ মাত্র ২৬ বছর বয়সে গজনির সিংহাসনে আরোহণ করেন। ১০০০ থেকে শুরু করে ১০২৭ খ্রিঃ
পর্যন্ত তিনি মোট ১৭ বার ভারতীয় উপমহাদেশে আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং প্রতিটি পুরানেই
সফলতা লাভ করে ইতিহাসে অপরাজেয় সেনানায়কের মর্যাদা লাভ করেন।
ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেন, His military life
is a record of unbroken success." প্রকৃতপক্ষে তার আক্রমণগুলোর কারণ ছিল রাজনৈতিক
ও অর্থনৈতিক। তাছাড়া যদিও তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে স্থায়ী আধিপত্য স্থাপনের ইচ্ছা পোষণ
করেন তথাপি তাঁর বিশাল সামরিক সাফল্য তাকে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে অমরত্ব দান করেছে।
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের উদ্দেশ্যাবলি:
সুলতান মাহমুদ
১৭ বার ভারত আক্রমণ হয়েছেন এবং ১৭ বারই তিনি গজনিতে ফিরে গেছেন। এ জন্য তাঁর অভিযানসমূহ
নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য কে করা যায়।
তবে ধর্ম প্রচার
বা রাজ্য বিস্তার অপেক্ষা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকেই অধিকাংশ ঐতিহাসিক প্রধান্য
দিয়েছেন। তাঁর অভিযানের প্রধান উদ্দেশ্যগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. ধর্মীয় উদ্দেশ্য:
বিরোধী সমালোচকদের
মতে, মাহমুদের ভারত আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামিতে দূবে মূর্তি ভাঙা করা
এবং মন্দিরসমূহ অপবিত্র করে ইসলাম ধর্ম প্রচার করা।
নিরপেক্ষ বিচারে
সুলতান পরিচালনাকারী মনে হয় না। কারণ, তিনি কখনো হিন্দুদেরকে বলপূর্বক ইসলাম ধর্মে
দীক্ষিত করেননি। তিনি ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে অভিযান প্রেরণ করেন নি। নিম্নে তা আলোচনা
করা হলো।
১. ধর্ম প্রচার
যে অপরিহার্য রাজকার্য তা আব্বাসীয় প্রথম খলিফাদের সময়ই শেষ হয়ে যায়। কাজেই তিনি দা
নিয়ে জেহাদ ঘোষণা করেননি।
২. সুলতান মাহমুদ
শুধু হিন্দুদের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেননি প্রয়োজনে তিনি মুসলমান রাজাদের বিরুদ্ধেঃ
অভিযান পরিচালনা করেন।
৩. হকি যান
অভিযান হতো, তবে তাঁর সেনাবাহিনীতে শুধু মুসলিম সৈন্য থাকত। কিন্তু তার সেনাবাহিনীতে
শু হিন্দু ও খোকার জাতি ছিল।
৪. সুলতান মাহমুদের
অভিযানগুলো যদি ধর্মীয় যুদ্ধ হতো তাহলে এগুলোতে জয় লাভ করে তিনি গাজী উপাধি ধারণ করতেন।
কিন্তু তিনি তা করেননি।
৫. সুলতান মাহমুদ
মাঝে মাঝে মদ্যপান করতেন যা প্রকৃত মুসলমান ধর্মযোদ্ধা সেনাপতিদের দ্বারা অসম্ভব কাছ
বলে প্রতীয়মান হয়।
২. রাজনৈতিক
উদ্দেশ্য:
সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল
সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক। হিন্দু রাজন্যবর্গ কর্তৃক সন্ধির শর্তভঙ্গ, সুলতানের প্রতি
তাদের আনুগত্য অস্বীকার, শত্রুপক্ষকে সাহায্য করে রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা এবং তাঁর
অধীন ভারতীয় উপমহাদেশের সীমান্ত রাজাদের বিদ্রোহ ইত্যাদি তাঁকে ভারতীয় উপমহাদেশ আক্রমণে
বাধ্য করেছিল।
তাছাড়া সর্বপ্রকার সম্ভাব্য কণ্টক দূরীভূত করে মধ্য
এশিয়ায় তিনি একটি শক্তিশালী সম্রাজ স্থাপনের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং এটা বাস্তবায়নের
জন্য তিনি ভারতবর্ষে অভিযান প্রেরণ করেন।
ঐতিহাসিক হাবিব
ও নিজামী বলেন, "সুলতান মাহমুদের প্রধান সংকল্প ছিল একটি তুর্কি পারস্য সাম্রাজ্য
প্রতিষ্ঠা করা এবং এর বাস্তবায়নে ভারতবর্ষে অভিযান পরিচালনা করা।"
৩. অর্থনৈতিক
উদ্দেশ্য:
সুলতান মাহমুদের
ভারত আক্রমণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক। ঐতিহাসিকগণ বলেন, এ সময়
দুর্ধর্ষ তুর্কি মুসলিম নেতা সুলতান মাহমুদ দেব-মন্দির ও বিগ্রহাদির ধ্বংস সাধন কন্ত
প্রভৃত ধনরত্ন লুণ্ঠন করার উদ্দেশ্যেই ভারত অভিযানে ব্রতী হয়েছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে তিনি যেসব মন্দির আক্রমণ করেছিলেন তা বিপুল ও বর্ণনাতীত ধনরত্ন পূর্ণ ছিল এবং তাদের মধ্যে কয়েকটি ছিল রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের কেন্দ্রস্থল। তিনি এ সব মন্দির পরধর্ম বিদ্বেষী না হয়ে, বরং অর্থনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যেই আক্রমণ করেছিলেন।
ভারত হতে সংগৃহীত অর্থ তিনি
স্বীয় রাজধানী গজনির সর্বাঙ্গীণ উন্নতির জন্য ব্যয় করেছিলেন। মাহমুদের এ অর্থ সম্পদ
সময়ে প্রয়োজনীয়তার বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন-
১. গজনির শাসনব্যবস্থাকে
সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা।
২. গজনিকে সমৃদ্ধশালী
ও আকর্ষণীয় নগরীতে পরিণত করা।
৩. বিশাল সৈন্য
বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ করা।
৪. মধ্য এশিয়ার
শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান।
৫. জ্ঞান-বিজ্ঞানের
পৃষ্ঠপোষকতা দান ইত্যাদি।
ঐতিহাসিকগণ
বলেন, রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য এবং গজনির সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদ্দেশেই
তিনি ভারতের মন্দিরগুলো ধাংস করে প্রভূত ধনরত্ন সংগ্রহ করে গজনি প্রত্যাবর্তন করতেন।
সুতরাং, একথা নিঃসন্দের বলা যায় যে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক
কারণেই সুলতান মাহমুদ ১৭ বার ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিলেন। এর পেছনে। ধর্মীয় উদ্দেশ্য
কিংবা রাষ্ট্রীয় সংযোজন করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না।
ড. ঈশ্বরী প্রসাদ
বলেন, "The temples off which Mahmud raided were storehouse of enormous
and untold wealth and also some of these were political centers." (মাহমুদ ভারতের
মন্দিরগুলো আক্রমণ করেছিলেন এজন্য যে, তাতে বিপুল ধনরত্ন ছিল এই তাদের মধ্যে কয়েকটি
রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের কেন্দ্রস্থল ছিল।
৪. সামরিক উদ্দেশ্য:
গজনির ক্ষমতাশালী
শাসক সুলতান মাহমুদ এর বার বার ভারতবর্ষে আক্রমণ, তাঁর সামরিক জনতা প্রকাশ পাওয়ার একটা
দিক লক্ষ্য করা যায়। তিনি নিজের ক্ষমতা, অপূর্ব তেজস্বিতা ও সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয়
দিয়েছেন।
নিজ সামরিক
শক্তি আরো শক্তিশালী করা এবং ভারতবর্ষে মুসলমান শাসনের পথ সু-প্রশস্ত করাকে তাঁর আক্রমণের
অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে গণ্য করা যায়।
পরিশেষে বলা
যায় যে, সুলতান মাহমুদ একজন শ্রেষ্ঠ বিজেতা ছিলেন। অধিকন্তু তিনি ছিলেন একজন পরাক্রমশালী
দ্বিগ্বিজয়ী বীর। সামরিক কৌশল এবং দক্ষতায় তৎকালীন কোন শাসক তার সমকক্ষ ছিলেন না।